পাথুরে বনের গল্প শুনুন

বন শব্দটা শুনলেই ঠিক কোন জিনিসটা আপনার মাথায় প্রথম কড়া নাড়ে বলুন তো? নিশ্চয়ই বিশাল এক খয়েরী গুড়ির সবুজ পাতায় মোড়া গাছ? একটা, দুটা কিংবা তিনটা নয়। শয়ে শয়ে বিরাটাকার এমন গাছ। হ্যাঁ, আজকে আপনাকে এমনই এক বনের কথাই শোনাব। তবে সে বনে গাছ নয়, রয়েছে কেবল পাথর। নাম তার পাথুরে বন। শিলিন পাথুরে বন।

নামের সাথে মিল রেখেই যেন বনটার পুরোটা ভর্তি হয়ে আছে এত্ত বিশাল বিশাল আর নানা রকমের পাথরে। আশ্চর্যরকম এই বনটা রয়েছে খুব দূরে কোথাও নয়। আমাদের এই এশিয়া মহাদেশেই। বাংলাদেশ থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত হাজার হাজার মানুষের দেশ চীনে রয়েছে এই পাথুরে বন। শুধু চীন নয়, শিলিন পাথুরে বনটি চীনকে ছাড়িয়েও উত্তরের দিকে থাইল্যান্ড, ভিযেতনাম ও বার্মাকেও চুঁয়ে গেছে অনেকটা। চীনের শিলিনে অবস্থিত এই পাথুরে বনের খুব কাছেই আছে রাজধানী কুনমিং। এখানে লম্বা হয়ে দাড়িয়ে থাকা চুনাপাথরের পাহাড়গুলোকে দূর থেকে দেখলে গাছের মতন লাগে বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছে পাথুরে বন।

৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বনটির ভেতরে আরো রয়েছে লিজিজিংএর পাথুরে বন, নাইগু পাথুরে বন, ঝিয়ুন গুহা, ইউ খাল, চ্যাঙ খাল, ডেডি ঝর্ণা ও কুইফেঙ গুহা। মনে করা হয় পাথুরে এই বনটির বয়স প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বছর। এর জন্ম নিয়ে বেশ মিষ্টি একটা গল্পও রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, অনেককাল আগে ঠিক এখানেই আশিমা নামের এক মেয়ে বাস করত। ই গোত্রের মেয়ে ছিল সে। একদিন একটা ছেলেকে খুব ভালোলাগল ওর। বিয়ে করতে চাইল ও সেই পছন্দের ছেলেটাকে। কিন্তু কেউ শুনলোনা আশিমার কথা। নিষেধ করে দিল ছেলেটার সাথে মিশতে। সবার এমন আচরণে খুব কষ্ট পেল আশিমা। কষ্টে কষ্টে একটা সময় পাথর হয়ে গেল ও। আর সেই থেকে ওখানে জন্ম নিল আরো অনেক পাথর। তৈরী হল পাথুরে বন। এখনো প্রতিবছর আশিমার জন্যে ই গোত্রের মানুষেরা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আলোর উত্সব বা টর্চ উত্সব করে ওখানে।

পৃথিবীর একোণে ও কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু পাথুরে বন আছে বৈকি! তবে সেসবের কোনটাই মিঙ রাজত্বের সময় সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠা শিলিনের পাথুরে বনের ধারে-কাছে আসতে পারেনা। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর ভেতরে থাকা সবচাইতে বড় আর আশ্চর্য পাথুরে বন হিসেবে একনামে সবাই চেনে একে। এমনিতে কুনমিংএর আবহাওয়া বেশ ভালো বিধায় অনেকে একে বসন্তের শহর বলেও ডাকে। এর ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারের ভেতরে রয়েছে মোট ৪০০ রকমের ফুল। পাথুরে বনের অবস্থান যেহেতু কুনমিং এর কাছেই, খুব একটা আলাদা নয় এর আবহাওয়াও।এখানকার আবহাওয়া সবসময় হালকা গরম-হালকা ঠান্ডা থাকায় বেশ আরামদায়ক জায়গা হিসেবে পরিচিত এটি সবার কাছে। আর চারপাশে কিছু ভালোমানের হোটেল গড়ে ওঠায় বলতে গেলে পর্যটকদের একেবারে তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে বনটি।

এখন যেখানটাতে বনটি দাড়িয়ে আছে কোটি কোটি বছর আগে সেখানে ছিল মস্ত বড় একটা সাগর। আর সেই সাগরের নীচেই ধীরে ধীরে চুনাপাথর জমা হয়ে একটা সময় কোন এক আশ্চর্য কারণে সাগরকে ছাপিয়ে মাথা উঁচু করে উঠে আসে পাথুরে বনের পাথরগুলো। পাথরগুলোর কোন কোনটা কয়েক মিটারের হলেও এখানে এমন কিছু পাথর আছে যেগুলো লম্বায় প্রায় ৪০ মিটার উঁচু। এমনিতে ধূসর দেখনে বনটিকে বৃষ্টি হলেই কালচে-খয়েরী দেখায়। শুধু রঙ ই নয়, এখানকার একেকটা পাথরের গায়ে লেগে আছে জায়গাটির হাজার হাজার বছরের গল্প। বৈদ্যুতিক ট্রেনের মাধ্যমে পুরোটা বনকে খানিক সময়ের ভেতরেই দেখে শেষ করে ফেলা যায় খুব সহজেই। কিন্তু এর গায়ে লেগে থাকা ঐ হাজার বছরের গল্পগুলোকে জানতে হলে আপনাকে হাঁটতে হবে ওগুলোর একেবারে কাছ দিয়ে। তবে সাবধান! আবহাওয়া বেশ ভালো হলেও মাঝে মাঝে অনেকটা রোদ ওঠে এখানে। ভালো জুতো, একটা ক্যামেরার সাথে সাথে তাই ছাতাটাও বেশ দরকার হয়ে পড়ে পাথুরে বনে হাঁটতে গেলে।

২০০৭ সালেই ইউনেস্কো শিলিন পাথুরে বনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্যকেন্দ্র বলে জানিয়ে দেয়। এছাড়াও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বেশ ভালো মানের বলে মনে করা হয় একে। তাই আর দেরী কেন? এক্ষুণি গিয়ে বসে পড়ুন ইন্টারনেটে আর দেখে নিন কতটা সুন্দর দেখতে শিলিন পাথুরে বন। আর যদি ইচ্ছে হয়, তবে কেবল ইন্টারনেটে নয়, বাস্তবেই ঘুরে আসুন এই চমত্কার জায়গাটিতে একবার।



মন্তব্য চালু নেই