পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই ঘুরে আসুন ‘দার্জিলিং’!

শিরোনাম দেখে আশ্চর্য লাগছে? আপনার আশ্চর্য লাগলেও লাগতে পারে, কিন্তু এটাই সত্যি! যাঁরা দার্জিলিংয়ের নাম শুনেছেন, বিবরণ শুনেছেন, কিন্তু যাননি। দার্জিলিং বিবরণে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের কথা শুনে দেখার ব্যাকুলতায় এরই মধ্যে আপনার মন আনচান হয়ে গেছে নিশ্চয়? এখন তো আরো ব্যাকুলতা বেড়ে গেল, তাই না? তাহলে দেরি কেন, চলুন ঘুরে আসি স্বপ্নের দার্জিলিংয়ে। কথা দিচ্ছি, কোনো পাসপোর্ট-ভিসা লাগবে না। চড়তে হবে না উড়োজাহাজেও। সোজা সড়কপথে একদম স্বল্প খরচে দার্জিলিং দেখে আসতে পারেন খুব সহজেই। শুধু ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত বাস টিকেটের জন্য ৫২০ টাকা আর খাগড়াছড়ি থেকে দার্জিলিং পৌঁছতে সিএনজি, পিকআপ বা চান্দের গাড়ি রিজার্ভ ভাড়া হাজার চারেক হলেই চলবে। তবে এ দার্জিলিং সেই দার্জিলিং নয়। এটি বাংলার দার্জিলিং। বাংলাদেশের দার্জিলিং।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে বাংলার দার্জিলিং অবস্থিত। এ দার্জিলিংয়ের স্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী নাম ‘সাজেক’। সাজেকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পাবেন মিজোরামের লুসাই পাহাড়। দেখতে পাবেন, মিজোরামের জনবসতি ও বাজার এলাকা।

কী! শেষে এসে সাজেকের নাম বলাতে ধোঁকা মনে হলো? একদম না। যাঁরা দার্জিলিং দেখে এসেছেন, তাঁরাই বলেছেন সাজেক আর দার্জিলিংয়ের মধ্যে কোনো তফাত নেই। দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য যা, সাজেকের প্রাকৃতিক দৃশ্যও একই রকম, একই রূপ, একই গুণ।

মেঘের চাদরে মোড়ানো পাহাড়, সবুজাভ বৃক্ষরাজিতে ঢেকে আছে ধবধবে সাদা কুয়াশা। বিশাল বিশাল গাছপালা, অজগর সাপের মতো আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা, সুউচ্চ পর্বত, ভোরসকালে সূর্যোদয় দৃশ্য—কোনোটাই দার্জিলিংয়ের চেয়ে কম নয়। দার্জিলিং ভ্রমণ করে আসা দর্শনার্থীদের ভাষ্যমতে বরং দার্জিলিয়ের চেয়ে বাড়তি কিছু রয়েছে সাজেকে।

কীভাবে যেতে হবে তা তো প্রথমেই বলেছি। আবার বলছি, ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ৩১৬ কিলোমিটার। ছয়-সাত ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন খাগড়াছড়ি। রাতে গেলে সকালে পৌঁছবেন আর দিনের সকালবেলা গেলে বিকেলে পৌঁছবেন। ঢাকার কমলাপুর, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর, কলাবাগান থেকে খাগড়াছড়ির বাস পাওয়া যায়। শ্যামলী, শান্তি পরিবহন, ইকোনো, ঈগল, সৌদিয়া, সেন্ট মার্টিন, এস আলমসহ অনেক রকমের বাস পাওয়া যায়। দিনে অথবা রাতে যেতে পারেন। শান্তি পরিবহনে গেলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। অন্যান্য পরিবহন হলে খাগড়াছড়ি সদর পর্যন্ত। খাগড়াছড়ি থেকে পিকআপ, চান্দের গাড়ি বা সিএনজি রিজার্ভ করে যেতে হবে সাজেকে।

পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক প্রশাসন বাঘাইহাট থেকে সাজেকের রুইলুই পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও পুলিশ স্কট দিয়ে আসা-যাওয়া বাধ্যতামূলক করেছে।

দূরে দর্শনার্থীদের কাছে সাজেকে যাওয়া মানেই কেবল সাজেকের লাল-নীল রঙে নির্মাণ করা উঁচু উঁচু রিসোর্ট, কটেজ দেখে ফিরে আসা নয়। সাজেক যাওয়ার উদ্দেশ্যই হলো দীঘিনালা থেকে সাজেক পর্যটন পর্যন্ত যেসব প্রাকৃতিক দৃশ্য রয়েছে, সেগুলো উপভোগ করা। সাজেক যেতে যেতে অথবা সাজেক থেকে ফিরতে ফিরতে দীর্ঘ রাস্তার মধ্যে কোথাও গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নিয়ে কোনো কিছুর ছবি তোলা, চা পান করা অথবা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া, আপাতত এ সুযোগ পাবেন না। আপনি যদি দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে চান, তাহলে মনে করবেন আপনার হাতে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় আছে।

এ দুই ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে সাজেকের রুইলুই পর্যটন, কংলক পাহাড় দর্শনসহ দুপুরের খাবার খেয়ে ঠিক বিকেল সাড়ে ৩টার সময় ফিরতে হবে। দুপুরের খাবার ইচ্ছা করলে যেখানে-সেখানে পাবেন না। কমপক্ষে দুই-তিন ঘণ্টা আগে যেকোনো রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে। কারণ, রেস্টুরেন্টগুলো অর্ডার না পেলে কোনো ধরনের খাবার বা নাশতা প্রস্তুত করবে না। তবে রাতযাপন করলে পরের দিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় পাবেন সাজেক উপভোগ করার জন্য। চাইলে আরো আগে বেলা ১১টার সময়ও ফিরতে পারেন।

প্রতিদিন বেলা ১১টার সময় বাঘাইহাট বাজার থেকে একসঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রহরা নিয়ে সাজেকের উদ্দেশে রওনা দিতে হয়। সেনাবাহিনীর স্কট মাসালং সেনাক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে দিলে সেখান থেকে পুলিশ সাজেক পৌঁছে দেয়। ঠিক ফেরত আসার সময়ও একই নিয়মে আসতে হবে।

এভাবে দুই থেকে তিনবার স্কট পরিবর্তন করতে পর্যটকদের দীর্ঘক্ষণ গাড়িতে বসে গরম রোদ সহ্য করতে হয়। এই গরমে সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ বমি করে দিতে পারে, মাথাব্যথা হতে পারে, রক্তচাপ বাড়তে পারে। সুতরাং সাজেকে যাওয়ার আগে এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে আগাম ব্যবস্থা নিয়ে গেলে ভালো।

যা-ই হোক, এত নিয়মের মধ্যেও শত কষ্ট করে সাজেকে পৌঁছতে পারলে সব কষ্ট ভুলে যেতে পারবেন এক নিমেষেই। রাত যাপন করতে পারলে রাতের দৃশ্য আর সকালের দৃশ্য যে কারোর কাছে লাগবে অপূর্ব।

সাজেকে আসার আগে কেউ যদি দার্জিলিংয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে ভুল করে সাজেক এলাকাটিকেও দার্জিলিং বলে বসবেন। তবে এক বছর আগের সাজেক আর বর্তমানের সাজেকের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এখন সাজেকে নতুন নতুন রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট নির্মিত হয়েছে। তাই থাকা-খাওয়ার জন্য তেমন অসুবিধা হয় না। সাজেক পর্যটনে অতিথি আপ্যায়নের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সাজেক রিসোর্ট, রুন্ময় রিসোর্ট, আলো রিসোর্ট, নিরিবিলি রিসোর্ট, জলবুক রিসোর্ট, হানিমুন কটেজ, য়ারুং রিসোর্ট, সেনি লুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড রেস্টুরেন্টসহ ইত্যাদি। সবচেয়ে কম খরচে ও উন্নত পরিবেশে থাকতে-খেতে চাইলে সেনি লুসাই রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্টে। এখানে জনপ্রতি ১০০-২০০ টাকার মধ্যে দুপুরের খাবার বা রাতের খাবার পাবেন।

অগ্রিম বুকিং ও খাবারের অর্ডার দিতে ফোন করতে পারেন এই নম্বরে—০১৮৭৯৪৫৬২৩৩, ০১৮৮১৬৮৪৮৩১।

1468745275-2

এ ছাড়া আরো রয়েছে, যেমন—ডোর ইন রিসোর্ট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, জলবুক রিসোর্ট, য়ারুং রিসোর্ট (০১৮৭৬১০০৬৫৬, ০১৮৬৫০৫৪৫০৫, ০১৭৩৭৪৪৩৩০৯), নিরিবিলি রিসোর্ট (০১৮৬৬৯৫৯৭৭৯, ০১৮৬৬০৩৫৮২৫), আলো রিসোর্ট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। সাজেকের রুইলুই পর্যটনকেন্দ্রটি মূলত একটি আদিবাসী গ্রাম। গ্রামটিকেই পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা করে গ্রামের মাঝখানে সুউচ্চ সাজেক রিসোর্ট নির্মাণ করে পর্যটনে রূপ দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরা ও লুসাই জনগোষ্ঠীরা এখানে সেই ১৮০০ সাল থেকে বসবাস করে আসছে বলে জানা যায়। বর্তমানে এ পর্যটন এলাকায় দুটো গ্রাম (দক্ষিণ রুইলুই ও উত্তর রুইলুই) মিলে ৯০ ত্রিপুরা পরিবার ও ১৭ লুসাই পরিবার রয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তর রুইলুইপাড়ার বাসিন্দা কুকিন্দ্র ত্রিপুরা। পর্যটনটি সরাসরি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে বলেও জানা যায়। নামে রুইলুই পর্যটনকেন্দ্র হলেও এর বিস্তৃতি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের কংলকপাড়া পর্যন্ত। দর্শনার্থীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থানের মধ্যে কংলক পাহাড়টি।

পর্যটন এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি জুনিয়র হাই স্কুল, একটি পাঠাগার, একটি তাঁতশিল্প কেন্দ্র, একটি গির্জা, একটি শিবমন্দির, একটি ক্লাব রয়েছে। এ ছাড়া পর্যটন গড়ে তোলার পর এখানে একটি পানির হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। এ পানির হাউস থেকেই রুইলুইবাসী পানি সংগ্রহ করে থাকে। তাই চলুন না, আর দেরি না করে ঘুরে আসি বাংলার দার্জিলিং।



মন্তব্য চালু নেই