পিয়াইনের পাথর ৫০ হাজার শিশু-কিশোরের জীবনরেখা

দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করার জন্য নদীই তাদের ভরসা। সিলেটের জাফলংয়ের পিয়াইন নদী থেকে পাথর খুঁজে খুঁজে জড়ো করে ডাঙ্গায় উঠানো তাদের পেশা। সংখ্যায় তারা হাজার হাজার। পিয়াইন তাদের জীবনরেখা। বাঁচার লড়াই করে। দিনভর এ নদী থেকে পাথর উত্তোলন করে। আবার হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও কোনো কোনো সময় অভিভাবকদের হাতে মার খেতে হয় তাদের। ভোর থেকে শুরু, বিকাল গড়িয়ে যায়। নামে সন্ধ্যা। অন্ধকার নামলেই সেদিনের মতো ইতি। ফের শুরু পরের দিন। পাহাড় থেকে নেমে আসা পিয়াইন নদীতে এভাবেই ওরা চালায় প্রাণরক্ষার লড়াই। লড়াই করছে প্রায় দু’লাখ মানুষ যার মধ্যে অর্ধলাখের মতো শিশু-কিশোর।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পিয়াইন নদী ঘিরেই যেন পাথর তোলার উৎসব। এদিকে পিয়াইন, ওদিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি নদী। ডাউকি নদী থেকেই উৎসারিত পিয়াইন নদী। এখানে হাজার হাজার শিশু-কিশোর পাথর উত্তোলনের কাজ করছে। যুগের পর যুগ। সকাল-সন্ধ্যা। কারও সঙ্গে মা-বাবা, ভাই-বোন আবার কেউ বা এতিম। ওদের রাত্রিযাপনের জন্য নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে অনেক বস্তি। যেমনÑ সংগ্রাম বস্তি, মামার বস্তি, বল্লাঘাট বস্তি, মোহাম্মদপুর বস্তিসহ প্রায় ১০টি বস্তি। পলিথিন আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি ৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট প্রস্থের মাথাগোঁজার আস্তানায় এমনিতেই ঠাঁই হয় না গোটা পরিবারের। তার উপর বৃষ্টি নামলে খাঁচার মুরগিরা যেভাবে থাকে, তেমন দশা হয় তাদের। রাত ১০টায় সংগ্রাম বস্তিতে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। জানালেন, ঝড়-বৃষ্টিতে ঝুপড়িতে থাকতে ভালো লাগে না, শিশুরা খুব কাঁদতে থাকে। এ কান্না বৃষ্টি ভেজার কষ্টে নয়, অন্ধকারের ভয়ে।

এখানকার শিশু-কিশোররা ঝড় বৃষ্টিতে ভিজতে অভ্যস্ত। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব শিশু নদী থেকে পাথর উত্তোলন করে। ঝড়-বৃষ্টিতেও। দিনের পর দিন পানিতে থেকে কাজ করায় শরীরে এক ধরনের শেওলা পড়ে গেছে। যে শেওলা তাদের শরীরকে তৈলাক্ত করে তুলেছে।

শাকিল (৮), সাগর (১০) ও শাপলা আক্তার (১৩)। নদীর মাঝখান থেকে লাগাতার ডুব দিয়ে দিয়ে পাথর তুলছে। সঙ্গে বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা খোদেজা বেগম। এ প্রতিবেদক শিশু দুটির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে মা সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘মাতলে কিতা ফ্যাট ভরতনি’ ( কথা বললে কি পেট ভরবে?)।

আপনার শিশুরা কি স্কুলে যায়? উত্তরে ক্ষোভ উগরে দিয়ে খোদেজা বললেন, ‘স্কুলে গেলে কিতা সংসার চলতনি’ ‘ আমরার খুরুতাইন (ছেলে-মেয়ে) লইয়া আফনে তাইনর চিন্তা করা লাগত না’। ফুট পনেরো দূরত্বের মধ্যে আরও ৫/৬ শিশু-কিশোর পাথর উত্তোলন করছে। তাদের নাম সুচনা, বেলাল, পপি, রিংকু, সোমা সাহা, আকরাম ও ফাতেমা। রোদে পুড়ে ঝুলে পড়ছে তাদের চেহারা। ভোর থেকে কাজ করছে, কিন্তু এখন দুপুরেও ১০ নৌকা পাথর তুলতে পারেননি। সন্ধ্যার আগে আগে ৩০ নৌকা পাথর তুলতে পারলেই পিটুনি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ভাত চড়বে উনোনে। পেট ভরে খেতে পাবে।

কথার ফাঁকে ছবি তুলতে চাইলে চিৎকার দিয়ে উঠে শিশুরা, চিৎকার শুনে এক অভিভাবক এসে বললেন, ‘তোমরা আমরার খুরুতাইনরে ফটো তুলবাইন না, ফটো তুললে আমরারে পয়সা দিয়া লাগত’। অভিভাবক রহিমা বেগম। বাড়ি টঙ্গীতে। ৬ বছর ধরে স্বামী-সন্তান নিয়ে পাথর তুলছেন। দুঃখ করে বললেন, শিশুসহ তাদের জীবন এ নদী ঘিরেই। সবার পরিণতিটা একই। অনিশ্চয়তা। মলমূত্র ত্যাগসহ গোসল-খাবার এ নদীতেই সারেন। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীরা যখন প্রতি মাসে প্রাকৃতিকভাবে অসুস্থ হয় তখনও তাদের রেহাই নেই।

নদীতে পাথর উত্তোলন করতেই হয় তাদের। সামান্য তফাতেই দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছিলেন ৭/৮ জন। কাছে যেতেই পরিচয় পাওয়া গেল তারা তিনটি পরিবার। এদের মধ্যে ৫ জনই শিশু। যাদের বয়স ৭ থেকে ১৫ মধ্যে। শিউলী, কান্তা ও পারভীনের বয়স ১৩ থেকে ১৬-এর মধ্যে। শিউলী হাত দেখিয়ে বলল, নদীতে কাজ শুরুর পর থেকে কখনও হাত-পায়ের নখ কাটতে হয়নি। পাথর আর বালির ঘষায় ঘষায় নখ কাটা হয়ে যায়। প্রায়ই হাত-পা কেটে রক্ত ভেসে যায় স্রোতে। ভালো হয় পানির রসে রসেই। জাহানারা বেগম কোলের শিশু ময়না ( ১)কে নৌকায় রেখে কাজ করছেন।

জানালেন, স্বামী তাজুল ইসলাম অসুস্থ। তিনিও কাজ করতেন। এখন ১৫/১৭ বছর বয়সী দু’মেয়েকে নিয়ে পাথর তোলার কাজ করেন। তাদের বিয়ের কথা ভাবছেন কিনা প্রশ্নে জানালেন, ‘ পাথরের কামলা অতানের কাছই আমরা ফুরি-পুয়াইন বিয়া দিতাম’ (পাথর শ্রমিকদের কাছেই মেয়েদের বিয়ে দেব)। পাথর শ্রমিক মিলন মিয়া জানিয়েছেন, ‘আমার বড় ছেলেটা অসুস্থ। তাই ১৫ হাজার টাকা দেবে এই শর্তে আমার ছোট মেয়ে সাথীকে (১৩) এক পাথর ব্যবসায়ীর বাড়িতে কাজে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু হাতে পেয়েছি মাত্র ৭ হাজার টাকা।

পাথর উত্তোলনকারী পান্না, বিজয়, আঁখি, রুবেল, সিয়াম, মিলন, প্রিয়া রানী, মিতা ঘোষসহ ১৫/২০টি শিশু-কিশোরের সঙ্গে পড়ালেখার বিষয়ে কথা বলে জানা যায়, পড়াশোনা করতে তাদের ইচ্ছে হয়, কিন্তু মা-বাবা তাদের ভোরেই ঘুম থেকে তুলে এনে নদীতে নামিয়ে দেয়। স্কুলে যাওয়ার কথা বললে খুব মারে। সংগ্রাম বস্তির মুসলিম ও হিন্দু দুই সংগঠনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও বিমল দাস জানালেন, এ নদীতে পাথর উত্তোলনকারী শিশু-কিশোর শ্রমিক আছে প্রায় ৫০ হাজার।

যাদের জীবন এ নদীকে ঘিরেই। নদী যখন আবার যৌবন ফিরে পায়, তখন মৃত্যু যেন চেপে ধরে বাঁধে গড়ে উঠা শ্রমিক বস্তিকে। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপে মুহূর্তে শত ফুট পানিতে তলিয়ে যায় নদী। পাথর তখন গভীর পানির নিচে। বেকার হয়ে যায় সবাই। ভাঙনের ছোবল খেয়ে শ্রমিক বস্তিগুলো জীর্ণ হতে থাকে। তখন কাজের চিন্তা বাদ দিয়ে অস্তিত্বের লড়াইতে নামতে হয়।

অন্য শিশুদের তুলনায় এখানকার শিশুরা কিছুটা খাটো প্রকৃতির। ধারণা করা হয়, ভারি পাথরের ঝুড়ি প্রতিনিয়ত মাথায় বয়ে বেড়ানোর ফলে তাদের এ অবস্থা। সংগ্রাম পুঞ্জি এলাকার মালিক এখানকার জমিদার ও রানী ন্যারোলা তেনসং।

এ এলাকায় পাথর উত্তোলনকারীদের প্রায় ৮০ শতাংশ বাস করেন। জমিদার শুধু বিনামূল্যে থাকার জায়গাই দেননি দরিদ্র এসব লোককে অর্থ দিয়েও সাহায্য সহযোগিতা করেন। ন্যারোলা তেনসং যুগান্তরকে জানান, উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এখানকার জমিদার কিংবা রানী। তাদের প্রথা অনুযায়ী তার জায়গায় দরিদ্রদের থাকতে দিচ্ছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের জন্য যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতাও করছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাথর উত্তোলনকারী শ্রমিকরা তাদের শিশু সন্তানদের পড়াশোনা করাতে চায় না। বাবা-মা যা করে সন্তানদের দিয়েও তা-ই করাচ্ছে।

এসব শিশু ও অভিভাবকদের নিয়ে তিনি একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা করছেন বলেও জানান। গোয়াইনঘাট উপজেলা শিক্ষা অফিসার হেমেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ জানান, পুরো এলাকায় শিশু-কিশোরদের সংখ্যা বেশি থাকলেও স্কুলে যাচ্ছে খুবই কম। সংগ্রাম পুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহমুদা খাতুন বলেন, শিশুদের দোষ নেই।

অভিভাবকরাই নিজেদের সঙ্গে শিশুদের কাজে নেন। শিক্ষিকা সানিয়া তাবাসসুম ও সীমা রাম্বাই জানান, শিশুরা পড়াশোনা করতে চায় না। এমনও দেখা গেছে স্কুলে ৩৫ জন পড়ুয়া। কিন্তু ক্লাসে থাকে মোটে ৫ থেকে ৬ জন। এ দু’শিক্ষিকার ভাষ্য, অভিভাবকদের শিক্ষার গুরুত্বের কথা বোঝাতে গেলে তারা চটে যান। কখনও কখনও বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থী নিয়ে এলেও পর দিন আবার পাথর তোলার কাজে লাগিয়ে দেয় অভিভাবকরা।

‘‘এখন তো ভিড় কম। নদীতেও কাজ কমছে। তাই অনেকেই চলে গেছে অন্য জায়গায়।’’ জানান গোয়াইনঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ হামিদুল হক ভূইয়া বাবুল। ‘‘আগে লেবার কম ছিল। এখন দুনিয়ার লেবার। সকালবেলা যদি আসতেন ভিড়টা দেখলে বুঝতেন। চা-বাগানে কাজ নেই। ভিড় তাই নদীতে।’’ অভিভাবকদের কর্মসংস্থানসহ সচেতন করে গড়ে তুলতে না পারলে এখানকার শিশুদের এমন মরণ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। পাথর ব্যবসায়ীরাও এসব শিশুকে দিয়ে টাকা কামানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

পাথর ব্যবসায়ী আবদুল মুকুর জানালেন, এখানকার শিশু-কিশোর শ্রমিকরা ২০ কেজি থেকে ৬০/৭০ কেজি পাথর নদী থেকে মাথায় করে তোলে। কখনও গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে আবার কখনও ৮/১০ ফুট পানির নিচ থেকে। নদীর পাড়ে গড়ে উঠা ‘ আলাউদ্দিন মেডিকেল হল’ এর পরিচালক ডা. জালাল উদ্দিন জানান, ২০১১ সালে ঠাণ্ডাজনিত রোগে শুধুমাত্র সংগ্রাম বস্তির ৩০ শিশুর মুত্যু হয়। তাছাড়া প্রায় প্রতি মাসেই কোন না কোন শিশু ঠাণ্ডাজনিত রোগে মারা যাচ্ছে। গত শীতে ৭ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

তিনি জানান, শীতকালে পিয়াইন নদীর পানি খুবই ঠাণ্ডা থাকে। তাই মৃতের সংখ্যাও বাড়ে। ডা. জালাল তার চোখের সামনেই অনেক শিশুকে স্রোতের টানে ভেসে যেতে দেখেছেন। পাথর উত্তোলনকারী জহির উদ্দিন জানালেন, ২ বছর আগে তার শিশু সন্তান মিনু’র মৃত্যু হয় এ নদীতে।

এখন বেঁচে থাকা দু’শিশু সন্তান দিয়ে অল্প পানি থেকে পাথর তোলান। স্ত্রী আর তিনি ডুব দিয়ে দিয়ে পাথর তোলেন। শহর-নগরে দেয়ালে টাঙানো পাথর উত্তোলনের ছবি দেখে মুগ্ধ হয় মানুষ। যারা মুগ্ধ হন তারা এখানে এলে, নিরীহ শিশু-কিশোরের জীবন সংগ্রাম দেখে বেদনাহত হবেন সন্দেহ নেই। ঘরে ফিরে গেলেও যন্ত্রণাবিদ্ধ শিশুদের মুখ ভেসে উঠবে তাদের চোখে। ভেসে উঠবে বারবার।যুগান্তর



মন্তব্য চালু নেই