পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ধার্মিক, কেন?

মোহাম্মদ (স.), যিশু খিস্ট, সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ কিংবা মুসা (আ.)- এরা সবাই পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর প্রতিষ্ঠাতা। আর সবার ক্ষেত্রেই যে বিষয়টি সাধারণ তা হলো, তারা সবাই পুরুষ। অথচ বিশ্বব্যাপী তাদের অনুসারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জরিপে উঠে এসেছে এমনই তথ্য।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে দেখা গেছে, পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি ধার্মিক হয়ে থাকেন এবং ধর্মটা তাদের কাছে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’। ধার্মিকতার দিক থেকে বিশ্বে পুরুষের অনুপাত ৭৯.৯ শতাংশ। আর নারীর অনুপাত ৮৩.৪ শতাংশ বলে দেখা গেছে পিউ’র জরিপে। এ পার্থক্যটা খুব বেশি নয়। দেশভিত্তিক অনুপাতে অবশ্য এ হারের কিছুটা তারতম্য আছে। যুক্তরাষ্ট্রে পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি। সেখানে ধার্মিক নারীর পরিমাণ ৬০ শতাংশ। বিপরীত দিকে পুরুষের হার ৪৭ শতাংশ।

প্রশ্ন হচ্ছে এর কারণ নিয়ে। তুলনামূলকভাবে নারীরা কেন পুরুষের চেয়ে বেশি ধার্মিক হয়? এর জবাবে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, জৈবিক কারণে এটা হয়ে থাকে। আবার অনেকে বলেছেন, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে এমনটা হয়ে থাকে। তবে পিউ’র মতে জৈবিক কারণটাই একমাত্র বিষয় নয়। বরং ধর্মীয় গোষ্ঠি এবং দেশভেদে পুরুষ এবং নারীদের ধর্মীয় আচরণ এবং বিশ্বাসে পার্থক্য হতে দেখা যায়।

তার মানে, এক্ষেত্রে তাদের সামাজিকীকরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবশ্য জৈবিক কারণটাও উপেক্ষা করা যায় না। ধর্মচর্চার দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়, নারীদের সহ্যক্ষমতা অনেক বেশি- বিশেষ করে অত্যাচার নির্যাতনের ক্ষেত্রে। যেসব শাসনামলে ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে সেই সময়ে ধর্মীয় বিষয়গুলো নারীরা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তাদের পরবর্তী বংশধরদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

কমিউনিস্ট সরকারগুলো সাধারণত ধর্মচর্চাকে সমর্থন করেন না। অনেক সময়ই তারা ধর্মচর্চাকারীদের নানাভাবে বাধা প্রদান করে থাকেন। সেই কমিউনিস্ট শাসনামলে বেড়ে ওঠা ধার্মিক ব্যক্তিদের তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে জানা যায়, তারা তাদের দাদী কিংবা নানীদের কাছ থেকে ধর্মের জ্ঞান পেয়েছেন। তাছাড়া যে শাসনামলই থাকুক না কেন- ঘরের ভেতর ধর্মচর্চার বিষয়টি প্রধানত নারীরাই দেখে থাকেন। আবার দেখা যায়, যেসব নারীর মধ্যে নারীসূলভ স্বভাবটা বেশি মাত্রায় থাকে তারাও বেশি ধার্মিক হয়ে থাকেন।

আবার নতুন কিছু ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেখানে নারীদের বড় ধরনের ভূমিকা স্বীকৃত। বিশেষ করে বিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া পেন্টেকস্টালিজম’র ক্ষেত্রে। এখানে মূল বিষয়গুলো পুরুষনির্ভর হলেও নারীদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মনে করা হয়, পরবর্তী প্রজন্মকে এই ধর্মে দীক্ষিত করতে নারীদের ভূমিকাই মুখ্য।

এছাড়া অনেকে মনে করেন, নারী এবং পুরুষ কোন পরিবেশে বেড়ে উঠলো, তারা কোন ধরনের মূল্যবোধ ধারণ করে- নারী এবং পুরুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ। আলাদা সংস্কৃতিতেও নারী এবং পুরুষের ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে। যেমন মুসলিম সমাজে নারী ও পুরুষের ধার্মিকতার হার প্রায় সমান। আবার খ্রিস্টান সমাজে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি ধার্মিক। সুতরাং সব সময় বিষয়টি জৈবিক নয়, এটা সাংস্কৃতিক একটা ব্যাপারও।

পিউ’র জরিপে আরো দেখা যায়, যেসব নারী ঘরের বাইরে কাজ করে তাদের ধার্মিকতার বিষয়টি পুরুষের মতোই। বিপরীতপক্ষে যেসব নারী বাইরের কাজে নিযুক্ত নয়, তাদের ধার্মিকতার হার অন্য নারীদের চেয়ে বেশি। বাইরে কাজকর্ম না থাকলে নারীরা ঘরে ধর্মচর্চার সুযোগ বেশি পান। এতে পুরুষদের ঘরের বাইরে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ জীবনের তুলনায় নারীদের সে ধরনের জীবন যাপন করতে হয় না।

অন্য একটি তত্ত্বমতে, যৌনতার নিয়ন্ত্রণের জন্য নারীদের বেশি ধার্মিক হতে উৎসাহিত করা হয়। খ্রিস্টান গির্জাও ধর্মকে নারীর নিরাপত্তার রক্ষাকবচ বলে মনে করে। সামজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নারীরা দারিদ্র্যকে বেশি ভয় করে এবং শারীরিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ধর্মবিশ্বাস এক্ষেত্রে তাদের জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

তথ্যসূত্র: দ্য ইকনোমিস্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট।



মন্তব্য চালু নেই