পুলিশ দম্পতি হত্যা: ঐশীর ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু

পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী হত্যায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া তাঁদের মেয়ে ঐশী রহমানের মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি হাইকোর্টে শুরু হয়েছে।

রোববার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চে এ শুনানি শুরু হয়।

প্রথমদিনে ঐশীর আইনজীবী আফজাল এইচ খান ও সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী শুনানি করেন। সঙ্গে ছিলেন মাহবুবুর রহমান রানা। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির।

শুনানির শুরুতে আফজাল এইচ খান আদালতকে বলেন, ‘এ মামলায় অনেক ভুলভাবে অভিযোগ গঠন ও রায় দেওয়া হয়েছে। আপিলে আমরা বিষয়টি পরিষ্কার করব। বিশেষ করে ঐশীর বয়স ও ডিএনএ টেস্টের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভুল রয়েছে।’

এরপর আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির এ মামলার ৭২০ পৃষ্ঠার পেপারবুক (ডেথ রেফারেন্সের নথি) পড়া শুরু করেন।

মামলার শুনানি বিষয়ে আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা বলেন, ‘আপিলে আমরা ২৫টি যুক্তি দেখিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম যুক্তি হলো মামলার বাদী ঐশীর চাচাকে জেরা করার সময় তিনি বলেছেন, তাঁর ভাই নিহত মাহফুজুর রহমান বিয়ে করেছেন ১৯৯৪ সালে। মেয়ে ঐশীর জন্ম হয়েছে ১৮ আগস্ট ১৯৯৬ সালে। এ ঘটনার সময় ঐশীর বয়স হয় ১৬ বছর। কিন্তু প্রসিকিউশন ১৯ বছর বয়স দেখিয়ে তাঁকে শিশু আইনে বিচার করতে দেয়নি। বাংলাদেশি ফৌজদারি আইন অনুযায়ী তিনি একজন কিশোরী। প্রাপ্তবয়স্ক হতে হলে তাঁর ১৮ বছর দরকার হতো। এ ছাড়া একজন আসামিকে ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ছয়টি এক্স-রে করতে হয়। সেখানে ঐশীকে মাত্র তিনটি টেস্ট করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী এসব পরীক্ষার এক্স-রে কপি আদালতে উপস্থাপন না করে শুধু রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।’

‘এ ছাড়া ২১ নম্বর সাক্ষী ডা. নাহিদ মাহজাবীন মোর্শেদের সাক্ষ্য আমলে নেননি আদালত। যিনি তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, ঘটনার সময় ঐশীর মানসিক ভারসাম্য ছিল না। এক বোতল হুইস্কি খেয়েছিল ঐশী রহমান।’

গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ২৫টি যুক্তি দেখিয়ে ঐশী রহমান হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন। আপিলে তিনি বলেছেন, তাঁর বিচার প্রক্রিয়া ছিল ভুলে ভরা। মিথ্যা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে তাঁকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বয়সের ক্ষেত্রে মামলার বাদীর বক্তব্য গ্রহণ করেননি আদালত।

মামলার বিবরণে জানা যায়, পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে মেয়ে ঐশী রহমানকে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর দুবার মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, অনাদায়ে দুই বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর অন্যটি সরাসরি বাতিল হয়ে যাবে।

একই সঙ্গে ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছর কারাদণ্ডাদেশ ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। মামলার অপর আসামি আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ এ রায় ঘোষণা করেন।

ওই দিন বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ ঐশীর প্রকৃত বয়স প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আর সে যে সাবালিকা, এটাও প্রমাণ হয়েছে।’ আসামিপক্ষ ঐশীর বয়সের পক্ষে যা যুক্তি দিয়েছে, তা যথাযথ নয় বলে মন্তব্য করেন আদালত।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘ঘটনার দিন ঐশী নেশাগ্রস্ত ছিল। তার ক্রিমিনাল ইনটেন্ট (অপরাধ সংঘটনের ইচ্ছা) ছিল। হঠাৎ করেই কোনো উত্তেজনা ছিল না, পূর্বপরিকল্পিতভাবে সে তার বাবা-মাকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। সে সুকৌশলে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে।’

পটভূমি

২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগের বাসা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরের দিন ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার দিন বিকেলে পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করেন ওই দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমান। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ ঐশীকে প্রধান আসামি করে তিনজনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক আবুল খায়ের। এ মামলায় বিভিন্ন সময়ে ৪৯ সাক্ষীর মধ্যে ৩৭ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।

২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে ঐশী রহমান বলেছিলেন, ‘২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট আমি ছয় পাতা ঘুমের বড়ি কিনেছিলাম। রাত ১১টার পর তিন পাতা বাবার কফিতে মিশিয়ে পান করাই। আর মায়ের কফিতে তিন পাতা মেশাই। কফি পান করার পর তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। পরে আমি চাকু দিয়ে বাবাকে স্ট্যাব করি। এরপর বাবা মারা যান। বাবাকে হত্যার পর আমি হুইস্কি পান করি। বাবাকে হত্যার পর একইভাবে মাকে চাকু দিয়ে স্ট্যাব করতে থাকি। একপর্যায়ে মা গোঙাতে থাকেন। এরপর মা আমার কাছে পানি চান। আমি তাঁকে পানি খাওয়াই। এরপরও মা যখন মারা যাচ্ছিলেন না, তখন মায়ের গলায় চাকু দিয়ে স্ট্যাব করতে থাকি। পরে মা মারা যান। বাবা-মাকে হত্যার পর কাজের মেয়ে সুমিকে ডাকি। দুজনে লাশ টেনে বাথরুমে রাখি। পরে কৌশলে ছোট ভাইকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই।’

আদালতে ঐশী আরো জানান, মা স্বপ্না রহমানকে হত্যার পর বঁটি দিয়ে চাবির গোছা কেটে চাবি নেন তিনি। এরপর লকারের তালা খুলে নগদ প্রায় লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে সকালে কাজের মেয়ে সুমি, ছোট ভাই ঐহীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। হত্যার পর দেশের বাইরে চলে যাওয়ারও পরিকল্পনা করেন ঐশী।



মন্তব্য চালু নেই