পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হলে জড়িতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

রিমান্ডে নেয়ার পর কোনো আসামি জিজ্ঞাসাবাদের সময় মৃত্যুবরণ করলে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তদন্তের জন্য বলা হয়েছে ৫৪ এবং ১৬৭ ধারা বাতিল সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে। একইসঙ্গে হেফাজতে নেওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩তে বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের যদি কোনো সন্দেহ হয় আটক ব্যক্তিকে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন। কাউকে আটক করার পর গ্রেফতারের কারণ এবং স্থান ১২ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে জানাতে হবে বলেও জানান আপিল বিভাগ।

পরোয়ানা ছাড়া ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ১৬৭ ধারা সংশোধন করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। রায়ের অনুলিপিতে বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর বৃহস্পতিবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৩৯৬ পৃষ্ঠার রায় আপলোড করা হয়।

এর আগে ২৪ মে ৫৪ ধারা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন।

৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে প্রায় ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন। হাইকোর্টের ওই রায় বহাল রেখে রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আজ সেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হল।

চার সদস্যের বেঞ্চ ওই রায়ে বলেছিলেন, ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কয়েকটি বিষয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় হাইকোর্ট কয়েক দফা সুপারিশ করে। এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন থাকবে। ৫৪ ও ১৬৭ ধারা প্রয়োগের বিষয়ে একটি নীতিমালা দেয়া হবে।

১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করেন তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের(ডিবি)সহকারী কমিশনার(এসি)আকরাম হোসেন। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়।

পুলিশ হেফাজতে রুবেলের মৃত্যুর পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে ১১ দফা সুপারিশ করা হয়।

কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক), সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, অরুণ চক্রবর্তীর স্ত্রীসহ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।

ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে আদালত ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায়ে বলেন, আইন সংশোধনের আগেই এই ১৫ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

হাইকোর্ট যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন :
ক. আটকাদেশ(ডিটেনশন)দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
খ. কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
গ. গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে।
ঘ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।
ঙ. গ্রেফতার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
চ. গ্রেফতার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন।
ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।
ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।



মন্তব্য চালু নেই