প্রত্যাশার বারুদ নিয়ে আসছে বাজেট

দশম জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশনে আজ (৪ জুন) দেশের ইতিহাসে ৪৪তম বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে। এই বাজেটের আকার হতে পারে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার মতো। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর এটিই সর্ববৃহৎ বাজেট। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ এ বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে। সঙ্গত কারণেই বিশাল এ বাজেট নিয়ে জনমনে প্রত্যাশার বুদবুদ স্ফীত হচ্ছে।

আজ বিকেল তিনটায় সংসদে আসন্ন ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এ বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তিনি নবমবারের মতো প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করবেন; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক বাজেট উত্থাপন। এর আগে বিএনপির অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সর্বোচ্চ ১২টি বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের আরেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এএমএস কিবরিয়া সাতটি বাজেট উত্থাপন করেন। আর টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটি এই সরকারের দ্বিতীয় বাজেট।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, আজ (৪ জুন) সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ও ২০১৫ সালের অর্থবিল উপস্থাপন করা হবে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ওপর আলোচনা হবে ৭ ও ৮ জুন; এরপর এটি পাস হবে। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হবে ৯ জুন এবং শেষ হবে ২৮ জুন। আর ২৯ জুন প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সমাপনী বক্তব্য দেবেন।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে ৩০ জুন।

প্রসঙ্গত, এবারই প্রথমবারের মতো থাকছে শিশু বাজেট। পদ্মাসেতু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির জন্য থাকছে বিশেষ বরাদ্দ। সদ্য নিষ্পত্তি হওয়া ছিটমহলবাসীর উন্নয়নের বিশেষ নির্দেশনা থাকছে।

আকারের সঙ্গে সঙ্গে বাজেটে বাড়ছে ঘাটতির পরিমাণও। একই সঙ্গে বাড়ছে করের আওতা। রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রতিবারের মতো এবারে অনেক নতুন নতুন খাতে কর আরোপের ঘোষণা আসতে পারে। বেশকিছু নিত্যপণ্যের আমদানির ওপর কর বসতে পারে। থাকছে আলোচিত সমালোচিত কালো টাকার প্রসঙ্গও।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটের আকার হতে পারে দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। যা চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেট ছিল প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। পরে কাটছাঁট করে সংশোধিত বাজেট নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।

তবে বাজেটের আকার বাড়লেও উন্নয়ন ব্যয় খুব বেশি বাড়ে না। প্রস্তাবিত বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ উন্নয়ন ব্যয়। বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় হয় বেতন ভাতা ও ভর্তুকিসহ অন্যান্য খাতে।

প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এটা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি। এডিপিতে প্রকল্প সহায়তার পরিমান হচ্ছে ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি ৬২ হাজার ৫০০ কোটি আসবে আভ্যন্তরীণ অর্থ ব্যবস্থা থেকে ঋণ হিসেবে। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর জন্য এডিপি ধরা হয়েছে আরো ৩ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা।

বাজেটে মোট রাজস্ব আয় দুই লাখ আট হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৩১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা আসবে এনবিআর-বহির্ভুত রাজস্ব খাত থেকে।

বিশাল আকারের বাজেটে ঘাটতিও থাকছে বড় ধরনের। নতুন বাজেটে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি ধরা হতে পারে ৮৭ হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৫ শতাংশ। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থবছর শেষে ঘাটতি প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে।

ঘাটতি মেটানো হবে অভ্যন্তরীণ উৎস ও বিদেশি সহায়তা থেকে। এজন্য ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৩৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই বিপুল ব্যাংক ঋণ বেসরকারি বিনিয়োগে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছে অর্থবিভাগ। কেননা দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে রেকর্ড পরিমান।

এছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে আসবে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর বাকি ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈদেশিক সহায়তা খাত থেকে আসবে বলে ধরা হয়েছে।

এবারের আগামী বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। এটা অবশ্য ৭ দশমিক ৩ শতাংশও হতে পারে। চলতি বাজেটেও প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের বলছে এবারের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। যদিও সরকার বলছে প্রবৃদ্ধি হবে আরো বেশি, ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।

এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ ৬ দশমিক ২ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করছেন অর্থমন্ত্রী। উন্নয়ন সহযোগীরা বিরোধীতা করলেও ভর্তুকি অব্যাহত থাকছে। এবারের বাজেটে এ খাতে ২৪ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা।

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ঘোষণা থাকছে। থাকছে পৃথক শিশু বাজেট। ৫ মন্ত্রণালয়ের আওতায় এজন্য ৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বাজেটে।

তবে গত কয়েক বছর ধরে ঘোষণা করলে বাস্তবায়ন করতে না পারায় এবার জেলা বাজেট থাকছে না। পদ্মাসেতুর জন্য বরাদ্দ থাকতে পারে ৫ হাজার কোটি টাকা। আর মেট্রোরেলের জন্য প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে। মুক্তির আশায় থাকা সিটমহলবাসীর জন্য বরাদ্দ থাকছে ৫০ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছর থেকে করের আওতা বাড়াতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। দেশের প্রতিটি উপজেলায় কর অফিস স্থাপন, সরকারি চাকরিজীবীর বেতন-ভাতার ওপর কর আরোপ, ন্যূনতম করের পরিমান বৃদ্ধি, প্রত্যেক বাড়িওয়ালাকে করের আওতায় আনা, পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয়ে উৎসে কর হার বাড়ানোসহ আসছে বাজেটে বেশকিছু খাতে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। করের আওতা বাড়াতে এসব উদ্যোগের প্রস্তাবনা ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন।

বাজেটে ব্যক্তি করের সর্বনিম্ন হার বাড়ানোর ঘোষণা থাকতে পারে। অঞ্চলভেদে সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত কর দিতে হবে। করের আওতা বাড়ানোর লক্ষ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের উৎসে কর দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হতে পারে। তবে দেশের শিল্প মহলকে খুশি করতে করপোরেট কর হার কমানো হচ্ছে। একই সঙ্গে সম্পদ কর বা সারচার্জ আরোপের নিট সম্পদের পরিসর বাড়িয়ে দুই কোটি টাকা থেকে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা করা হবে। ব্যক্তি আয়ের কর সীমা দুই লাখ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ করা ঘোষণা থাকছে প্রস্তাবিত বাজেটে।

এছাড়া চাল, গম, ভুট্টা বীজ, সানফ্লাওয়ার অয়েল, চিনি, ন্যাপথালিন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, ঝুট, এমএস রড, কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিস, মোবাইল সেট, মডেম, রাউটারসহ আরো বেশকিছু পণ্যের আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম শুল্কারোপ করা হতে পারে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বাড়তে পারে। যাতে মূল্যস্ফিতি আরো বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।



মন্তব্য চালু নেই