প্রথমে জুতায়, তারপর পেপারওয়েট করে নেয়া হলো হীরা!

কোহিনুরের মতো বিখ্যাত নয় এই হীরা। আকারেও কোহিনুরের থেকে বেশ কিছুটা ছোট। কাটা এবং পালিশ করার আগে কোহিনুর ছিল ৭৯৩ ক্যারাট, যেখানে না–কাটা ভিক্টোরিয়া ডায়মন্ড ছিল ৫০১ ক্যারাট। তবে সাদা ফ্যাটফ্যাটে, নাক–চ্যাপ্টা কোহিনুরের থেকে সবুজাভ ভিক্টোরিয়া ডায়মন্ড অনেক বেশি সুন্দর দেখতে। রানিমার মুকুটের মাথায় চড়ে কোহিনুর জাতে উঠে গেছে, এই যা।

কোহিনুরের মতো ভিক্টোরিয়া ডায়মন্ড নিয়ে কোনও যুদ্ধবিগ্রহও হয়নি। দুই হীরে খনিজ পরিচয়েও আলাদা। কোহিনুর পাওয়া গিয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর খনিতে, আর ভিক্টোরিয়া দক্ষিণ আফ্রিকায়। ‘‌দ্য গ্রেট হোয়াইট’‌ বা ‘‌ইম্পিরিয়াল ডায়মন্ড’‌ নামেও খ্যাত ভিক্টোরিয়ার বাজারি নাম ছিল ‘‌জেকবস্‌ ডায়মন্ড’‌।

১৮৯১ সালে আলেকজান্ডার ম্যালকম জেকব নামে যে সাহেব লন্ডন শহরে প্রথম হীরেটিকে নিলামে তুলেছিলেন, তাঁর নামে নাম। মজাটা শুরু হয়েছিল সেই নিলাম থেকেই। অত বড় হীরে কার কেনার ক্ষমতা আছে, তাই সাধাসাধি করা হচ্ছিল হায়দরাবাদের নিজাম মাহবুব আলি খান–কে। নিজামের ঠিক মনে ধরেনি হীরেটা। তিনি নিমরাজি হয়েছিলেন।

অনেক দর কষাকষির পর সে আমলের ৪৬ লাখ টাকা দাম দিতে রাজি হয়েছিলেন। পাছে খদ্দের হাত ফসকে যায়, তাই নিজামের থেকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা জমা রেখে দেন নিলামওয়ালারা। চুক্তিপত্রে লেখা ছিল, বাকি টাকা দিয়ে হীরেটা কিনতে হায়দরাবাদের নিজাম আইনত বাধ্য থাকবেন। যদিও ইওরোপের জহরত ব্যবসায়ীরা খুব খুশি ছিলেন না সেই দামে।

তাই সম্ভবত নিজামকে হাতে রেখে আরও শাঁসালো খদ্দেরের খোঁজ চলছিল। কিন্তু একদিন মাথায় হাত। জমার টাকাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!‌ এবার নিজাম বাহাদুর ছাড়বেন কেন!‌ তিনি কোর্টে টেনে নিয়ে গেলেন নিলামওয়ালাকে। ফয়সলা হল, ৪৬ লাখের অর্ধেক দামে জেকবস্‌ ডায়মন্ড চলে এল হায়দরাবাদের ফলকনামা প্রাসাদে। কিন্তু রাজা–বাদশাদের ব্যাপার, তাঁদের যুদ্ধ জিতেই আনন্দ। লুটের মাল কী হল, সে খোঁজ রাখাটা তাঁদের মানায় না। জেকবস্‌ ডায়মন্ডের খোঁজ নিজাম পরিবারেও কেউ রাখেনি।

মাহবুব আলি খান মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে ওসমান আলি খান তাঁদের চৌমহলা প্রাসাদে বাবার একজোড়া পুরনো জুতো খুঁজে পেলেন। তার একপাটির মাথায় বসানো চকচকে পাথরটা দেখে তাঁর বোধহয় সন্দেহ হয়েছিল। পরখ করে দেখা গেল, সেটি বিশুদ্ধ হীরে!‌ হ্যাঁ, সেই ভুলে যাওয়া জেকবস্‌ ডায়মন্ড। এবার ওসমান আলি খান, হায়দরাবাদের শেষ নিজাম, তিনিই বা হীরেটিকে নিয়ে কী আর করবেন। পেপারওয়েট বানিয়ে নিজের টেবিলে রেখেছিলেন। দরকারি কাগজপত্র যাতে উড়েটুড়ে না যায়!‌

১৯৯৫ সালে নিজামি রত্নভান্ডার থেকে এক কোটি ৩০ লক্ষ ডলার, মানে তখনকার প্রায় ৭৫ কোটি টাকায় হীরেটি কিনে নেয় ভারত সরকার। সেটি এখন বহাল তবিয়তে রক্ষিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুম্বইয়ের ভল্টে। ২০০২ এবং ২০০৭ সালে হায়দরাবাদের সালার জং মিউজিয়ামে নিজামশাহির অলঙ্কারের প্রদর্শনীতে নিয়ে আসা হয়েছিল হীরেটিকে। লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখেছিল। কোহিনুর ভারতে ফেরত আসা উচিত কিনা, সেই নিয়ে এখন বিস্তর বিতর্ক।

ভারত সরকার জানিয়েছে, ব্রিটিশরা কোহিনুর চুরি, বা ডাকাতি করে নিয়ে যায়নি। মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র দলীপ সিং উপহার হিসেবে কোহিনুর তুলে দিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার জিম্মায়। ওদিকে যাঁরা কোহিনুর ফেরতের দাবিতে সোচ্চার, তাঁদের বক্তব্য, মহারাজা রঞ্জিৎ সিং রীতিমত উইল করে কোহিনুর দিয়ে যান পুরীর জগন্নাথদেব–কে।

কিন্তু ১৮৩৯ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর সেই অন্তিম ইচ্ছাপত্র কার্যকর হয়নি। প্রায় এক দশক পর দ্বিতীয় ইঙ্গ–শিখ যুদ্ধের সময় বিজয়ী ব্রিটিশ কোহিনুরটি হস্তগত করে দেশে নিয়ে যায়। আর কোহিনুরের নিজস্ব ইতিহাস বলে, ভুবনবিখ্যাত হীরেটির প্রাথমিক মালিকানা নিয়েই বহু সংশয়, সন্দেহ আছে। কাজেই ভারতের সরকারি অবস্থান জানার পরেও বিতর্ক হয়ত চলতেই থাকবে।

কিন্তু যে জিনিস এক নিজাম জুতোর আগায় পরতেন, আরেকজন পেপারওয়েট বানিয়ে রেখেছিলেন, সেরকমই আরেকটা হীরে কার কাছে রইল, তাতে কীই বা এসে যায়!‌ যদিও টাওয়ার অফ লন্ডনের সংগ্রহশালায় রাখা কোহিনুর দেখতে দেওয়ার নামে টিকিট বিক্রি করে ব্রিটিশরা বিলক্ষণ দুপয়সা কামায়। সেটা যদি গাত্রদাহের কারণ হয়, তবে আলাদা কথা।



মন্তব্য চালু নেই