প্রধানমন্ত্রীকে ঠকিয়ে সরকারি অর্থ তছরুপ!

মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়ে গত ৯ মাসে ২১০ কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে বিমান। উড়োজাহাজ দুটি ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে চালানোর কথা বলে মিশর থেকে ভাড়া নেয়া হয়। ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা খোদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও মিথ্যাচার করেছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে ভাড়া নেয়া হয় এ দু’টি উড়োজাহাজ। কিন্তু শুধু হজ মৌসুমেই এদু’টির শতভাগ ব্যবহার হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, বাকি সময় বসিয়ে রেখেই মাসে ২৪ কোটি টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। নয় মাসে ভাড়া-মেরামতসহ অন্যান্য খাতে এই ২১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা বিমানের কোনো কাজে আসবে না। এদ’টি উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়া হয়েছে পাঁচ বছরের জন্য। আর পাঁচ বছর পর আগের অক্ষত অবস্থায় ফেরত দিতে হবে। আর শর্ত অনুযায়ী, দুই বছরের আগে ফেরত দিলে জরিমানা গুণতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমানের অসাধু কর্মকর্তারা বোয়িং ৭৭৭-২০০ সিরিজের এয়ারক্রাফট দুটি ভাড়া নেয়ার সময় অনৈতিক উপায়ে আয়ের (কমিশন) বিষয়টি মাথায় রেখেই চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তির সময় তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির লাভালাভের কথা বিবেচনায় নেয়নি। ফলে উড়োজাহাজ দুটি অলস ফেলে রাখলেও প্রতি মাসে আড়াইশ’ ঘণ্টা হারে সংশ্লিষ্ট মালিককে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ভাড়া দিতেই হবে। চুক্তি বাতিলের ক্ষমতাও রাখা হয়নি। ফলে মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ভাড়ার দায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিমানকেই বহন করতে হবে। আবার মেয়াদ শেষে এয়ারক্রাফট দুটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। তখনও মোটা অংকের টাকা খরচ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর একজন এপিএস জানিয়েছেন, বিমানের এই সিন্ডিকেট প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ওয়েট লিজে (এয়ারক্রাফট, ক্রু, মেনটেনেন্স, ইন্স্যুরেন্সসহ) উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়ার অনুমতি নেয়। কিন্তু পরে তারা তথ্য গোপন করে ড্রাই লিজে (শুধু এয়ারক্রাফট) ভাড়া নিয়ে সরকারপ্রধানের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিমানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করে থাকে। নানা অজুহাতে এয়ারক্রাফট ভাড়া নেয়া বিমানের এ সিন্ডিকেটের কাজ। পরিচালনা পর্ষদের কাছে তারা এমনভাবে প্রস্তাব উপস্থাপন করে যা ফেরত পাঠানো সম্ভব হয় না।’

তিনি জানান, এয়ারক্রাফট ভাড়ার ক্ষেত্রে বিমানের সিন্ডিকেট এমনভাবে চুক্তি করেছিল তাতে উড়োজাহাজ দুটি ৫ বছরের আগে ফেরত দেয়ার বিধান ছিল না। বিষয়টি তিনি জানতে পেরে সেই চুক্তি পরিবর্তন করেন। এরপর সেটা ৫ বছরের পরিবর্তে ২ বছর করা হয়। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আহম্মেদ এই অবস্থার জন্য বিমানের সাবেক বিদেশি এমডি কেভিন জন স্টিলকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, ‘কেভিনই এ দুটি জাহাজ ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু ভাড়া নেয়ার মধ্যে প্রক্রিয়াগত মারাত্মক ভুল থাকায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জাহাজ দুটিকে নিউইয়র্ক ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেয়নি। যার কারণে বর্তমানে জাহাজ দুটি অলস পড়ে আছে।’

জানা গেছে, হজ মৌসুমের দুই মাস এয়ারক্রাফট দুটি শতভাগ ব্যবহৃত হয়েছে। সে হিসাবে গত ৭ মাসে (হজের ২ মাস ছাড়া) জাহাজ দুটি বসিয়ে রেখে ১৬৮ কোটি টাকা স্রেফ জলে ফেলেছে বিমান।

বিমানের মার্কেটিং বিভাগ বলছে, গত ৭ নভেম্বর ফিরতি হজ ফ্লাইট শেষে আবার আগের মতো এয়ারক্রাফট দুটি বসিয়ে রেখে ফাও ভাড়া গুণতে হচ্ছে। অন্যথা বিমানের নিজস্ব উড়োজাহাজ বসিয়ে রেখে ভাড়া জাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। তাতে আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে বিমান। এ অবস্থায় দু’কূল হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে বিমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।

বিমানের ফাইন্যান্স বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী এয়ারক্রাফট দুটি ৫ বছরের জন্য ভাড়া নিলেও ২ বছরের আগে ফেরত দেয়া যাবে না। ফেরত দিতে হলে বড় অংকের অর্থ জরিমানা দিতে হবে। আর যদি ২ বছর উড়োজাহাজ দুটি রেখে দিতে হয় তাহলে এ সময়ে শুধু ভাড়া বাবদ জাহাজ দুটির পেছনে বিমানের অহেতুক খরচ হবে ৫৭৬ কোটি টাকা। আর চুক্তি অনুযায়ী মেয়াদ শেষে এয়ারক্রাফট দুটির অবস্থা আগের পর্যায়ে ফেরত নিতে কমপক্ষে আরও ২শ’ কোটি টাকা ব্যয় হবে। মারাত্মক আর্থিক সংকটে থাকা রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের জন্য ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স থেকে ভাড়ায় আনা এই দুটি এয়ারক্রাফট এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক (প্রকৌশল) উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান মিশর থেকে ভাড়া আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজ দুটি টেকনিক্যালি ত্রুটির কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেন, ‘এই ত্রুটি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সহনীয়।’ তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে বিমানের রুট অনুযায়ী উড়োজাহাজ বেশি থাকলেও শিগগিরই বিমান লন্ডন ও জেদ্দা রুটে ফ্লাইট বাড়াচ্ছে। এছাড়া টরন্টো, সিডনি, গুয়াংজুসহ ৪-৫টি নতুন রুট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।’ কিন্তু এগুলো কখন চালু হবে তা তিনি বলতে পারেননি। আর এ সময় পর্যন্ত বিমান মিশরীয় কর্তৃপক্ষকে অহেতুক মাসে ২৪ কোটি টাকা ভাড়া দিয়ে যাবে কেন এ প্রশ্নেরও তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মারাত্মক তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, বিমানের ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টরা সবকিছু জেনেশুনে শুধু কমিশন বাণিজ্যের জন্য এই এয়ারক্রাফট দুটি ভাড়া নিয়েছিল।

একদিকে ভাড়া নেয়ার সময় মোটা অংকের কমিশন বাণিজ্য, অপরদিকে মাসিক ভাড়ার টাকা থেকে আরেক দফা কমিশন। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে সিন্ডিকেটের গড় আয় ১০ কোটি টাকার বেশি। এ টাকার মূল জোগানদাতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের হোতা ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের ভিপি হাসান ও বিমানের সাবেক এমডি কেভিন জন স্টিল।

অভিযোগ রয়েছে, এমডি না থাকলেও বর্তমানে কেভিন স্টিল প্রতি মাসে ২-৩ কোটি টাকা মাসোহারা পাচ্ছেন বিমানের বিভিন্ন সেক্টর থেকে। এর মধ্যে মিশর থেকে আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া, জেদ্দা, জার্মান, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে কার্গো ও যাত্রীর জিএসএ নিয়োগ থেকেও টাকা আসে। আর এই আন্তর্জাতিক চক্রের সহযোগী হিসেবে আছেন বিমানের ৩ পরিচালক, ২ প্রভাবশালী বোর্ড মেম্বার, টেকনো ফাইন্যান্স কমিটির ৩ জন প্রভাবশালী সদস্য, অপারেশন ও ট্রেনিং বিভাগের দুজন প্রভাবশালী সদস্য। এরাই কৌশলে কমিশন বাণিজ্যের জন্য কোনো প্রয়োজন ছাড়াই বোয়িং ৭৭৭-২০০ এয়ারক্রাফট দুটি ভাড়া নিয়েছিল।

জানা গেছে, বিমান দুটি এয়ারক্রাফট ড্রাই লিজে (শুধু এয়ারক্রাফট) ভাড়া নেয়ার কারণেই মূলত যুক্তরাষ্ট্র ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে চালানোর অনুমতি দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এজেন্সির আইন হলো- এই রুট চালাতে হলে বিমানকে ওয়েট লিজে (এসিএমআই) এয়ারক্রাফট ভাড়া নিতে হবে। এরপর তড়িঘড়ি করে বিমান বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চায়। তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠায় যে কোনো মূল্যে ড্রাই লিজকে ওয়েট লিজে রূপান্তরের। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়েও চিঠি পাঠায় বিমান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর মনোভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।



মন্তব্য চালু নেই