প্রিয় জাফর স্যার, কেন ছাত্রলীগের বিচার চান না আপনি?

রাগ ও অভিমান শব্দ দুটোর মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। রাগের উৎপত্তি প্রচণ্ড ক্রোধ থেকে। আর অভিমানের পেছনে কোনও না কোনওভাবে স্নেহ, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা থাকে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায়, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের মন্তব্যে-বক্তব্যে প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ার চেয়ে এক ধরনের অভিমান লক্ষ্য করেছি। ‘যন্ত্রণায় ভুগছি’, ‘খুব কষ্ট লেগেছে’- এই জাতীয় শব্দ বাক্য কী যথেষ্ট এমন অসভ্য, বর্বর, সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে বর্ণনা করবার জন্যে? নাকি দুঃষ্কর্মটি ছাত্রলীগ করেছে, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের একটি ছাত্র সংগঠন সে কারণে ক্ষোভের মাত্রা অনেকটাই তরল হয়ে গেছে!

প্রিয় জাফর স্যার, এই অসভ্যতার ঘটনায় আপনার চেয়ে আমরা কষ্ট পেয়েছি আরও বেশি, যারা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। কেন ছাত্রলীগের অন্যায়, অপরাধ চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলা যাবে না। এই ছাত্ররা তো চিহ্নিত। তবে কেন আপনি এখনও ছাত্রলীগের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাননি? শাস্তি চাননি? শিক্ষকদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে কেন বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেননি? আপনার কথা শুনে মনে হয়েছে আপনি ছাত্রলীগের এই আচরণে খুব বিস্মিত! বলেছেন, ‘যে ঘটনা আমি দেখেছি তা জীবনে কখনো দেখবো বিশ্বাস করিনি।’ কেন স্যার, বিস্ময়ের কি আছে? অবিশ্বাস্য মনে হবার কী কারণ? আপনি তো এই বাংলাদেশেরই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত একজন শিক্ষক। ছাত্রলীগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী করেছে, কী করছে তা কী আপনার জানা নেই? এমন ঘটনা কী এটাই প্রথম? বরং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কী করেনি ছাত্রলীগ! বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন, সন্ত্রাসী হামলা, শিক্ষক নিপীড়ন, নির্যাতন কোনটিই তো নতুন নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণে ছাত্রলীগ তো সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এক জসিমউদ্দিন মানিকই তো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে নিজেকে ‘ধর্ষণের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ করে তুলেছিলেন নিজেই। তিরস্কার নয়, মানিককে বিদেশে পাঠিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। হল দখল, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি এসব তো অতি গতানুগতিক। বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে কোপানোর পর ছাত্রলীগ নিয়ে বিস্ময়ের আর কী থাকে বাকি? কেন বিস্ময় প্রকাশ করছেন আপনি? বরং বিস্মিত আমরা যখন একদিকে শিক্ষকদের উপর বর্বর আক্রমণ, হামলা চলছে তখন ওসি জালালাবাদ, আখতার হোসেন হাত জোর করে তাদের হামলা থামাতে অনুরোধ করেছেন। এ ছবি প্রকাশিতও হয়েছে। হাত জোর করে, অনুরোধ করে কখনো সন্ত্রাস থামে? পুলিশের দায়িত্ব কী হাত জোর করা নাকি আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া? সোনার ছেলেদের অন্যায় প্রশ্রয়, আশ্রয় এই পর্যায়ে আমরা নিয়ে গেছি যে, পুলিশের ইউনিফর্ম পরে তাদের কাছে হাত জোর করতে হয়!

পুলিশ ছাত্রলীগকে ছাড় দিতেই পারে, ছেড়ে দিতেই পারে, অভ্যাসবশত। তাই বলে আপনিও তাদের বিরুদ্ধে প্রবল না দাঁড়িয়ে, নিজের গলায় ফাঁসি নিতে চাইবেন? আপনার গলায় ফাঁস লাগানো কী কোনো সমাধান, অপরাধীর বিচার ও শাস্তি না চেয়ে?

‘গায়ের চামড়া মোটা করেছি… সহ্য করেছি আরো সহ্য করবো’- ভীষণ আবেগী মন্তব্য। অভিমান আছে। এই মন্তব্যে ক্রোধ নেই। এতে তো অন্যায়কারীদের অপরাধ পুলক আরো বেড়ে যাবে স্যার, কেননা সহ্য ক্ষমতা বাড়লে তাদের নির্যাতন ক্ষমতাও বাড়বে এবং পুলক মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ। আর আপনিই যদি এই কথা বলেন, তবে অন্য সাধারণ মানুষদের তো পিঠে বস্তা বাঁধা ছাড়া উপায় থাকবে না কোনো।

‘ভিসি ছাত্রদের লাগিয়ে দিয়েছেন’ এই মন্তব্যকেও মেনে নিতে পারছি না। ভিসি শয়তান আর এই ছাত্ররা সাধু এমন তো নয়। ভিসি যেমন অসভ্য, সততাহীন; এই ছাত্ররাও তাই। তারা কারো দ্বারা প্রভাবিত বললে চলবে কেন, তারা কী কেউ শিশু? প্রত্যেকেই প্রাপ্তবয়স্ক। প্রভাবিত হলে, কেউ বললেই কী কেউ বাবা মায়ের গায়ে হাত তোলে? শিক্ষক তো পিতৃমাতৃতুল্যই।

হামলাকারীরা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে ঝাপিয়ে পড়ে। কেন, ছাত্রলীগ কী আগে কখনো ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে সন্ত্রাস করেনি। ব্লগার হত্যাকারিরাও তো আল­াহু আকবর, আল­াহু আকবার বলতে বলতে মানুষ হত্যা করে, তাই বলে কী এই ধর্মীয় মৌলবাদিদের খুব ধার্মিক ভাববার কোনো কারণ আছে? ধর্মীয় ছদ্মবেশিদের সঙ্গে এদের কী পার্থক্য আছে, চেতনার ছদ্মবেশে? চেতনার ফিল্টারের কথা আপনি বলেছিলেন, মুখস্ত চেতনা দিয়ে কোনো লাভ হয় না। চেতনা ধারণ করার বিষয়। দেশপ্রেম থাকলে চেতনা এমনিতেই তৈরি হয়। এরা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান কেবল মুখস্ত করেছে মাত্র, এদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের কি মিল আছে? যে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন চলছে সেই উপাচার্যও তো চেতনারই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার কী চেতনাবিরোধী লোককে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিতে পারে! ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ পরিষদ’ ব্যানারে আপনারাও আন্দোলন করছেন। এই চেতনাধারীর বিরুদ্ধে যদি আন্দোলন করতে পারেন, তাহলে ছাত্রলীগের ‘আগাছা’দের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে দাঁড়াতে অসুবিধা কোথায়?

স্যার, আর কেউ জানুক, না জানুক, আপনি তো জানেন আপনাকে কত ভালোবাসি, শ্রদ্ধাকরি। ‘একজন আদর্শ মানুষ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল’নামে আপনার একটি সাক্ষাৎকারের বই করেছিলাম শুধু আপনাকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসার কারণে। বড় হয়েছি আপনার দিপু নাম্বার টু, হাত কাটা রবিন, টুকুনজিল পড়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি আপনার কাছে। অনেক আন্দোলন, সংগ্রামে আপনাকে পাশে পেয়েছি। সাহসী মানুষ আপনি। মৌলবাদীরা আপনাকে মুরতাদ ঘোষণা করেছে। আপনি ভয় পাননি। সেই আপনি ছাত্রলীগের অন্যায় আচরণে, অসভ্য বর্বর হামলায় বর্জ্রকণ্ঠ হচ্ছেন না, চিৎকার নেই, আর্তনাদ নেই! ছাত্রলীগকে দায়ী করে বিচার ও শাস্তির দৃষ্টান্তমূলক দাবি নেই!

স্যার, ছাত্রলীগের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা মনে করে আপনি যদি ‘এই ছাত্রলীগ’কে মূল্যায়ন করতে চান, তবে তা হবে নেহাত বোকামী। ঐতিহ্যের ছাত্রলীগ এখন কেবলই স্মৃতি! শেষ করছি আপনার কথা দিয়েই। বলেছেন, ‘কার কাছে বিচার চাইব’- এই যদি হয় পরিস্থিতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, ভেঙে পড়েন আপনি, বিচার চাইবার জায়গাটিও না থাকে, তবে আমরা কোথায় যাব, কার কাছে যাব! ভালো থাকুন স্যার, আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।

লেখক : সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র। ডিরেক্টর, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ। [email protected]



মন্তব্য চালু নেই