“প্রেম যেখানে আছে, সেখানে শরীর থাকবে, হৃদয় তো শরীরের বাইরের কিছু নয়”

[শামসুর রাহমান। পঞ্চাশদশকের শক্তিমান বাঙালি কবিদের একজন। জন্ম ২৩ অক্টোবর, ১৯২৯, মাহুতটুলি, ঢাকা, মৃত্যু ১৭ আগস্ট, ২০০৬। ১৯৯১ সালে ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র শামসুর রাহমান সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল হুমায়ুন আজাদের নেয়া সাক্ষাৎকার—‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা।’ এবং এটি হুমায়ুন আজাদের ‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। সাক্ষাৎকারটির খানিকটা সংক্ষেপে সম্পাদনা করে কথাবলি’র পাঠকদের জন্য আবার প্রকাশ হলো।]

শামসুর রাহমান, পৌষের-এ ভোরবেলায় আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই। আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম সম্ভবত বাইশ বছর আগে, তখন আপনি এতো পরিচিত ছিলেন না। এর মাঝে পৃথিবী, বাঙলাদেশ, আপনি, আমি সবাই বদলে গেছি। আমি যখন গ্রামে ছিলাম, তখন আমি আপনার নাম শুনি নি, যদিও এমন অনেকের নাম শুনেছি যাঁরা এখন অপরিচিত। এ-বাইশ বছরে আপনার বয়স বেড়েছে, আপনার অবয়ব পরিবর্তিত হয়েছে, আপনি সে-রোম্যান্টিক তরুণ থেকে আর্কষণীয় প্রবীণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এখন আপনার নাম সারা বাঙলাদেশে, বাঙলাদেশের বাইরেও পরিচিত। এখন আপনি এক ধরনের ফ্যাশনও হয়ে উঠেছেন : কিশোরীরা, কিশোররা, তরুণেরা, নির্বোধ অধ্যাপকেরা, দুশ্চরিত্র আমলারা, এমনকি মাংসল চিত্রতারকারাও আপনার নাম উচ্চারণ করে, আপনার কবিতার পংক্তি আবৃত্তিও করে। অর্থাৎ অনেক পরিবর্তন ঘ’টে গেছে। আজ ভোর বেলায় আপনার সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চাই, সে-কথা হবে অত্যন্ত খোলামেলা, যদিও ধারণা আপনি খোলামেলা কথাকে আজ ভয় পান। আপনার ভেতরটি, আমার মনে হয়েছে, অনেক দিন ধ’রে নানা কারণে বন্দী হয়ে আছে, যদিও কবিতায় তা প্রকাশ পায়, কিন্তু কথায় তা সব সময় প্রকাশিত হয় না। আপনার কথা মনে হ’লে প্রথম আপনার একটি কাব্যগ্রন্থের কথা মনে পড়ে, সেটি আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ- প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, এবং এর পরে মনে পড়ে রৌদ্র করোটিতে-র কথা। তারপর আপনি বহু কবিতা লিখেছেন। আপনার কবিতার সংখ্যা এখন সম্ভবত একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই, অন্যদের থেকে আপনি অনেক বেশি কবিতা লিখেছেন। আপনার যাত্রা শুরু হয়েছিলো, আমি যতোটা বুঝেছি, একজন অত্যন্ত ব্যক্তিগত, আপনারই ভাষায়, ‘শিল্পের শহীদ’রূপে; কিন্তু এখন আপনি অনেকটা রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়েছেন। আপনার কবিতা বিকশিত হয়েছে, আপনার কবিতা আমাদের অনেকটা রূপান্তরিত করেছে, আমাদের চেতনাকে শাণিত, আধুনিক এবং ভবিষৎমুখি করেছে; এজন্য এখন আপনি বাঙালির গৌরবেও পরিণত হয়েছেন। আমরা এখন কথা শুরু করতে পারি- প্রথমে আমি জানতে চাই, আপনি কীভাবে কবিতা লেখেন?

আপনি নিজেও কবি, এবং জানেন সৃজনশীল প্রক্রিয়া বেশ রহস্যময় ও জটিল। রহস্যময় এ-অর্থে বলছি যে একজন কবি নানাভাবে কবিতা লিখতে পারেন। কখনো এরকম হয় যে একটি শব্দ হয়তো মঞ্জরিত হচ্ছে কবির মনে, তারপর সেই শব্দটিই হয়তো তাঁকে দিয়ে একটি কবিতা লিখিয়ে নিলো। হয়তো তিনি অফিসে যাবেন, কিংবা কোনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে যাবেন, সেই মুহূর্তে একটি লাইন ঝলসে উঠলো তাঁর মনে। হয়তো সে মুহূর্তে লেখা হয় না, কিন্তু ওই পংক্তিটি তাঁর মনে কাজ করতে থাকে, পরে সেটা কবিতা হিশেবে রূপায়িত হয়। আবার হয়তো একটি নির্ধারিত বিষয়, যেটা তাঁর মনে কাজ করছে, সেটা সম্পূর্ণভাবে এসে যায়, এবং সেটা তখন কবি লিখে ফেলেন। আমার বেলায় এই সবগুলো প্রক্রিয়াই কাজ করে। কখনো একটি পংক্তি, কখনো একটি বিষয়; অনেক সময় প্রথম পংক্তিটি লেখার পর আমি জানি না কবিতাটি কীভাবে শেষ হবে। আমার মনে হয় এটা প্রায় প্রত্যেক কবির বেলায় ঘটে।

আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না বার বার সংশোধন করেন?

এক বসাতে কখনো কখনো একটি কবিতা লেখা হয়, কখনো কখনো আবার বেশ কয়েকবার বসতে হয়, এবং সংশোধন করতে হয়। একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে, রৌদ্র করোটিতে-তে ‘কৃতজ্ঞতাস্বীকার’ ব’লে একটি কবিতা আছে প্রথম পাণ্ডুলিপিতে এই কবিতাটি দিয়েছিলাম, যা ছাপা হয়ে গিয়েছিলো, সেই সময় আমি আবার কবিতাটি নতুন ক’রে লিখি, আগাগোড়া পাল্টে দিই। মুনীর চৌধুরী আমার এ- গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে যুক্ত ছিলেন, তাঁকে আমি বললাম যে কবিতাটি আমি নতুন ক’রে লিখেছি, যেটা ছাপা হয়েছে সেটা তো দেওয়া যাবে না। তখন তিনি প্রথমত বললেন যে- কবিতা ছাপা তো হয়ে গেছে, ক্ষতি হবে যদিও তবু তুমি যখন বলছো তখন আমরা নতুন ক’রে এই ফর্মাটা ছাপাবো। এটাই আমি বোঝাতে চাইছি যে অনেক সময় একটি কবিতা লেখা হয়ে যাবার পরেও আদ্যপান্ত পরিবর্তন করতে হয়। আমার মনে হয় অনেক কবিই এটা করেন।

তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটি যন্ত্রণা আছে, বিশেষ ক’রে শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকেরা এ-যন্ত্রণা বেশি ক’রে ভোগ করেন। তৃতীয় বিশ্বে বাস করতে হয় সামাজিক, রাজনীতিক, সামরিক ইত্যাদি পীড়নের মধ্যে। এ-পীড়ন আপনি কতোটা বোধ করেছেন, এবং তা কতোটা কবিতায় প্রকাশ করেছেন?

তৃতীয় বিশ্বের কবিদের অনেক জ্বালা, অনেক বেদনাবোধ, এবং দায়িত্ববোধ আছে। যেজন্য ক্রমশ আমার কবিতা সেই ভেতরের পৃথিবী থেকে বাইরের পৃথিবীর দিকে গেছে। সামাজিক অনাচার অবিচার এবং স্বৈরশাসন নানা ধরণের উৎপীড়ন, শৃঙ্খলাবদ্ধতা-এ সবের বিরুদ্ধে আমার মন রিঅ্যাক্ট করেছে, আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। আমার মনে হয় আমার অনেক কবিতাতেই এর প্রকাশ ঘটেছে।

এ-বিক্ষোভকে আপনি কবিতায় পরিণত করেছেন, এবং ব্যক্তিগতভাবেও আপনি বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, যা আপনার সামাজিক ভূমিকার মধ্যে দেখা গেছে। এটার সঙ্গে কবিতার সম্পর্কটা কী-আপনি একটু ব্যাখ্যা করবেন?

একজন ব্যক্তিই কবিতা লেখেন, তাঁর বিক্ষোভটা তাঁর ব্যক্তিগত হ’লেও আমি যেহেতু নিঃসঙ্গ নই, আমার এ-বিক্ষোভের মধ্যে অনেকের বিক্ষোভই প্রতিফলিত। সুতরাং আমার মনে হয়, সেটা আর আমার একার বিক্ষোভ থাকে না, অনেকের বিক্ষোভে পরিণত হয়। আমি এভাবেই দেখি।

আপনার একটি কবিতায় আপনি নিজেকে বলেছেন ‘শিল্পের শহীদ’। কিন্তু আমার মনে হয় যে আপনি এখন অনেকটা রাজনীতির শিকার হয়েছেন। এ সম্পর্কে আপনার কী মত?

রাজনীতির শিকার ঠিক আমি বলবো না, আমি মনে করি যে কবিতা রাজনীতি ও জীবনের সঙ্গে যুক্ত, এবং সেটা কবিতারও বিষয় হ’তে পারে। আসলে একটি কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতা হলো কিনা, তার নান্দনিক দিক থেকে, সেটা একটা বিচার্য বিষয়। সেটা যদি না হয়ে থাকে তাহলে আমাকে বলা যেতে পারে যে আমি রাজনীতির শিকার হয়েছি। কিন্তু সেটা যদি কবিতা হযে থাকে তবে আমি বলবো না আমি রাজনীতির শিকার হয়েছি। বরং আমি রাজনীতিকে শোষণ ক’রে সেটাকে কবিতায় রূপান্তরিত করতে পেরেছি।

আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে?

আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই, আমার বিশ্বাস এটুকু যে আমি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করি, আর ব্যক্তির বিকাশ, তাঁর সৃজনশীল বিকাশেও আমি বিশ্বাসী। এ-পৃথিবীর সব মানুষের কল্যাণ হোক এবং মানুষ প্রগতির দিকে এগিয়ে যাক এই বিশ্বাসও আমার আছে।

আপনি কোন ধরনের সমাজ ব্যবস্থায় স্বস্তি পেতেন, সুখ বোধ করতেন?

আমি তেমন একটি সমাজে স্বস্তিবোধ করবো যেখানে মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে না, মানুষের পরার কাপড় থাকবে, খাবারের নিশ্চয়তা থাকবে, এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব ক্ষুণœ হবে না- এরকম সমাজে আমি থাকতে পছন্দ করবো যে-সমাজ শোষণহীন এবং যেখানে দারিদ্র্যের নিপীড়নে মানুষ মারা যাবে না এবং তাঁর ব্যক্তিসত্তাটা ক্ষুণœ হবে না।

আমাদের দেশ এখন নানাভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে সম্ভবত জেনারেলদের শাসনের ফলেই। আমাদের দেশে মৌলবাদী প্রবণতা বেড়েছে। শুধু যাঁরা মৌলবাদী রাজনীতি করে, তাদের মধ্যেই নয়, সাধারণদের মধ্যেও এ-ব্যাপারটি ঘটেছে। এটা আমাদের শিল্প সাহিত্য রাজনীতি সব কিছুর জন্য ক্ষতিকর। এ-মৌলবাদী প্রবণতা বাঙালির জন্যে যে একদিন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে তাতে কি আপনি আতঙ্ক বোধ করছেন?

হ্যাঁ, আতঙ্কবোধ করছি। আপনি জানেন বাঙলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। প্রত্যেকেরই নিজের নিজের ধর্ম পালন করার অধিকার আছে, কিন্তু এই ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে অনেক ধর্মব্যবসায়ী অনেক ধরনের কাজ করছে, যেটা আমি মনে করি দেশ ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। যেমন পীরবাদের কথাই ধরুন। এরা দেশের ক্ষতি করে, তবু মানুষ সেদিকেই ধাবিত হয়, কেননা আমাদের দেশে শিক্ষার অভাব রয়েছে। অনেকেই কুসংস্কারাছন্ন, এমনকি শুধু সাধারণ মানুষ নয়, নিরর মানুষ নয়, যারা শিক্ষিত তাদের মধ্যেও কুসংস্কার আছে। তারা ধর্মের বাহ্যিক দিকটার দিকে বেশি ধাবিত হয়, এর ফলে মৌলবাদী শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠছে। এবং সেটা আস্তে আস্তে বিরাট আকার ধারণ করছে। এ সম্পর্কে যাঁরা প্রগতিশীল এবং বিবেকবান মানুষ তাঁদের সর্তক হওয়া উচিত। ধর্ম যদি ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকে, সেটার কোনো ক্ষতিকর দিক থাকতে পারে না, আমার মা কিংবা আমার পিতা যদি ধর্ম পালন করেন আমার সেটা বাধা দেয়ার কিছু নেই, কারণ সেটা কারো ক্ষতি করছে না। কিন্তু রিলিজিঅন যখন অর্গানাইজ্ড্ হয়ে যায়, সুসংগঠিত হয়, তখনই ক্ষতি হয়। কেউ ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপালন করলে আমি তার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু কেউ যদি ধর্মের নামে অধর্ম করে, এবং ধর্ম যদি অর্গানাইজ্ড্ ফর্মে অধর্ম করতে থাকে, তখন আমি তার বিরুদ্ধে অবশ্যই কথা বলবো। সব প্রগতিশীল বিবেকবান ব্যক্তিরই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত।

আপনি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপ্রবণ কি না ?

ধর্ম ছাড়াতো কোনো মানুষ নেই। আমি মনে করি আমার ধর্ম হলো মনুষ্যধর্ম, সেটা যদি বলেন, তবে আমি ধর্মপ্রবণ। কিন্তু প্রচলিত অর্থে যেটাকে ধর্মপ্রবণ বলা হয়, সে-অর্থে আমি ধর্মপ্রবণ নই।

আপনি কি মদ্যপান করেন?

এক সময় করতাম, এখন করি না।

সম্প্রতি আমাদের দেশে একটি ‘গণঅভ্যুত্থান’ ঘ’টে গেছে এবং বাঙালি এখন নানা রকম স্বপ্ন দেখছে। আপনার কি মনে হয় বাঙালির ওই স্বপ্ন সফল হবে?

আমার জীবনে এতো বেশি স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, সে-স্বপ্ন আমারই হোক বাঙালি জাতিরই হোক। নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে আমি খুশি হবো। কিন্তু আমার কেনো যেনো আশঙ্কা হয় স্বপ্ন খুব শিগগিরই সফল হবে না।

বাঙলাদেশে যদি একটা উগ্র ডানপন্থী মৌলবাদী দল ক্ষমতায় আসে তাহলে বাঙলার ভবিষ্যৎ কেমন হবে ব’লে আপনি মনে করেন?

মধ্যযুগের মতোই তমসাচ্ছন্ন।

ওই দেশে আপনি বাস করতে পারবেন?

বাস করা মুশকিল হবে।

আপনি তখন জীবিত থাকবেন ব’লে কি মনে হয়?

আমার মনে হয় না আমি তখন জীবিত থাকবো।

অর্থাৎ তারা আপনাকে জীবিত রাখবে কিনা?

আমার মনে হয় না তারা আমাকে জীবিত রাখবে।

আপনি আজকাল কী ধরনের কবিতা লিখছেন?

নানা ধরনের কবিতা লিখছি। প্রেমের কবিতা লিখছি, যে-গণআন্দোলন হলো সেটার প্রতিক্রিয়া নিয়ে লিখছি, অর্থাৎ আমাকে যা যা প্রভাবিত করেছে তাই লিখছি। আমি কখনো মনে করি না যে নির্ধারিত এই কবিতাই লিখবো, কিংবা এই কবিতা লিখবো না। একজন কবি একই সময়ে নানা ধরনের কবিতা লিখতে পাবেন। আবার নানা সময়ে নানা ধরনের কবিতা লিখতে পারেন।

আপনার প্রেমের কবিতা কি শুধুই কল্পনার সৃষ্টি? না ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ?

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধই অধিকাংশ কবিতা।

আপনার এ-প্রেমের কবিতাগুলোর মধ্যে ক-জন প্রেমিকাকে খুঁজে বের করা যাবে?

বেশ কয়েকজনকে।

এখন এই ষাট বছর পেরিয়ে যাবার পর প্রেমের আবেগ কেমন? সেই তিরিশ বছর বয়সের মতোই, না অন্যরকম?

আমি মনে করি মানুষের প্রেমের যে-অনুভূতি তা সবচে তীব্র এবং প্রবল। আমার দেহের বয়স বেড়েছে এবং মনেরও কিছু বয়স বেড়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমার প্রেমের অনুভূতি এখনো তীব্র আছে, এবং আমৃত্যু আমি ভালোবেসে যেতে পারবো।

বাঙলা সাহিত্য আপনার কী রকম পড়া আছে?

মোটামুটি পড়া আছে।

মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য কিছু পড়েছেন?

চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলি পড়েছি। আরো কিছু কিছু পড়েছি।

মঙ্গলকাব্য ব’লে যে একটা ধারা আছে…

না, ওটা আমি পড়ি নি।

আধুনিক বাঙলা সাহিত্য সম্পর্কে আপনার কী মত? এর মান সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

আধুনিক বাঙলা সাহিত্যকে উঁচুমানের সাহিত্য ব’লে মনে করি।

কতোটা উঁচু ব’লে মনে করেন?

বেশ উঁচু।

একে কি আধুনিক ফরাশি বা ইংরেজি সাহিত্যের মতো উঁচু মানের মনে করেন?

আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে শুধু যদি আমরা বিচার করি তাহলে বলবো রবীন্দ্রসাহিত্য পাশ্চাত্যের অন্যান্য সাহিত্যের মানের সমতুল্য। পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা যায়। কিন্তু অন্যদের বেলায় বোধ হয় একথাটা বলা যাবে না। সে-অর্থে বাঙলা আধুনিক সাহিত্য পাশ্চাত্য আধুনিক সাহিত্যের সমমানের নয়।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপনি এতো নিশ্চিত কেনো?

কেননা তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতা এবং আমাদের সাহিত্যকে তিনি যে-পর্যায়ে নিয়ে গেছেন সেটা আধুনিক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের সমপর্যায়ভুক্ত। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন।

আপনি শুধু কবি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলুন।

তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ব’লে বলবো না, তাঁর কাব্যপ্রতিভা বিদেশি বড় বড় কবিদের সঙ্গে তুলনীয়। কল্পনার বৈভবে এবং উপলব্ধির গভীরতায় রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর যে-কোনো মহৎ কবির সমতুল্য।

আপনার মনে কখনো কি প্রশ্ন জেগেছে পাশ্চাত্যের বড় বা মাঝারি লেখকেরা যতোটা মৌলিক, তাঁরা যেমন নতুন কবিতা, নতুন উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন, রবীন্দ্রনাথ কি সে-অর্থে নতুন কবিতা সৃষ্টি করেছেন? বিশ্বের পটভূমিতে, বাঙলার পটভূমিতে নয়। যেমন ধরুণ, ওয়ার্ডস্ওঅর্থ বা কিট্স বা শেলি, বা ফরাশি রোম্যান্টিকেরা যেভাবে নতুন রোম্যান্টিক কাব্যধারা প্রবর্তন করেছেন, যা সারা বিশ্বের হয়ে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথ কি ঠিক সে-ধরনের অভিনব মৌলিক কাব্যধারার স্রষ্টা?

গ্যাটের কাব্যে জীবনের যে-বিচিত্র দিক দেখি তা হয়তো রবীন্দ্রনাথের কাব্যে নেই, কিন্তু একটি বিশেষ দিক, যেমন জীবন ও জীবনদর্শনের ব্যাপারটা, এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা, সেটা রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব একটা ব্যাপার।

রবীন্দ্রনাথের যে-জীবনদর্শন বা আধ্যাত্মিকতা, এটা তো প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ।

হ্যাঁ, কিন্তু তিনি যেভাবে সেটাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন সেটা আমার মনে হয় মৌলিক। এক হিশেবে ধরতে গেলে কোনো আবেগ তো মৌলিক নয়। জন্ম মৃত্যু ঈশ্বরে বিশ্বাস কি অবিশ্বাস, এগুলোল কোনোটাই আজকে মৌলিক নয়, কিন্তু একজনের রচনার গুণে এবং দৃষ্টিভঙ্গির ধরনে মৌলিক হয়ে দাঁড়ায়। সে-অর্থে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই মৌলিক। ফাউস্ট-এ জীবনের যে-বিভিন্ন দিক পাই, রবীন্দ্রকাব্যে অতোটা হয়তো নেই, তবে তাঁর মানের যে-উচ্চতা সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই।

আধুনিক বাঙলা সাহিত্য সম্পর্কে আমার মনে হয় আমরা ঠিক মৌলিক স্রষ্টা নই। পাশ্চাত্য থেকে উপন্যাস, কবিতা, ছোটগ্রল্পের ধারণা পেয়েছি। আপনার কি মনে হয় আমাদের কবিরা বা ঔপন্যাসিকেরা এমন কোনো ধারার সৃষ্টি করেছেন, যা পশ্চিমে এর অনেক আগে সৃষ্টি হয় নি?

আপনি যেভাবে বলছেন যে আধুনিক বাঙলা সাহিত্য মৌলিক নয়, আমি ঠিক ওভাবে বলবো না, কারণ এক হিশেবে প্রতি বছরই মৌলিক কিছু সৃষ্টি হয় না এবং পৃথিবীর নানা দেশের মধ্যে ব্যবধান এতো বেশি লুপ্ত হয়ে গেছে যে ঠিক ওরকম বিচ্ছিন্নতা নেই যে একজনের সঙ্গে আরেক জনের সম্পর্ক থাকে না। যেমন প্রাচ্য পাশ্চাত্যকে প্রভাবান্বিত করেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তাছাড়া প্রাচীন গ্রিকদের রচনাবলি ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশের সাহিত্যই মৌলিক নয়। গ্রীকদের অধমর্ণ প্রায় সব দেশের সাহিত্য।

যেমন?

যেমন ধরুণ ফার্সি কাব্যসাহিত্য দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন গ্যাটে। এমনকি কবির পাশ্চাত্যে নন্দিত হয়েছেন। এধরনের অনেক ব্যাপার আছে, ওখানে প্রভাব ফেলেছে। আমার মনে হয় অনেক সময় আমরা গ্রহণ করেও নতুন সৃষ্টি করতে পারি। সেটা নানা ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে, যেমন, আধুনিক বাঙলা সাহিত্য গ্রহণ করেছে ঠিকই, কিন্তু অনেক দিকে থেকে নতুনত্বের দাবিদারও হ’তে পারে। আপনি যেভাবে মৌলিক বলেছেন ওরকম হয়তো নয়, কিন্তু এক ধরনের মৌলিকত্ব্ এসে যায় ওটাকে পরিবর্ধন বা অন্যভাবে নির্মাণের ক্ষেত্রে।

আমি যে-মৌলিকতার কথা বলছি তা চেতনার মৌলিকতা। যেমন আধুনিক কবিতায় যে-সমস্ত চেতনার প্রকাশ ঘটেছে সেগুলোর প্রথম বিকাশ কি জীবনানন্দ, বা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বা বিষ্ণু দে বা পরে আপনি ঘটিয়েছেন? না, এ-চেতনার প্রকাশ পাশ্চাত্যে ঘটেছে, আমরা সে-চেতনা নিয়ে আমাদের বিষয়, দেশ এবং আবেগকে প্রকাশ করেছি? এ-ব্যাপারটিই আমি বলতে চাই।

সে-অর্থে বলতে গেলে আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু আমাদের দেশ, পরিবেশ, মানুষ ও প্রকৃতি বিষয়কে নিয়ে লেখা হয়েছে এর মধ্যে পাশ্চাত্যের কিছু ধারণা থাকলে এটা কি আপনি বলবেন না যে এর মধ্যেও কিছু মৌলিকত্ব আছে? অনেক সময় বিষয়ের জন্যে নয়, প্রকাশভঙ্গির জন্যের একটি লেখায় অভিনবত্বের স্পর্শ লাগে।

বাঙলা কবিতার এক হাজার বছরের একটি ধারা রয়েছে, সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি কারা ব’লে আপনি মনে করেন?

বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, তিরিশের কয়েকজন কবি…

কারা কারা?

জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু।

এদের মধ্যে কার প্রতি আপনি বেশি অনুরক্ত?

আমি অনুরক্ত বেশি জীবনানন্দ দাশের প্রতি।

কেনো?

তাঁর যে জগৎ, সে-প্রকৃতিই বলুন, কিংবা আধুনিক চৈতন্যের কথাই বলুন, সেটা আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। তিনি মানুষের মনের অবচেতনের অন্ধকার দিক নিয়ে কাজ করেছেন। তিনিই বোধহয় বাঙলা কবিতায় প্রথম পরাবাস্তববাদের সূত্রপাত করেন। সেটা আমাকে আকর্ষণ করেছে। তাঁর শব্দসৃষ্টি, শব্দচেতনা এগুলোও আমাকে আকর্ষণ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের কোন কবিতাটিকে আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়?

একটি কবিতার কথা বলা মুশকিল। আমার মনে হয় তাঁর বিভিন্ন কবিতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ-যেমন, বনতলা সেন, আট বছর আগের একটি দিন, বিশেষ ক’রে আমি বলবো ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

অবসরের গান কবিতাটির কথা মনে পড়ে?

হ্যাঁ।

ওটি সম্পর্কে কী ধারণা?

আমার মনে হয় কবিতাটি খুবই ভালো। কিন্তু খুব বেশি দীর্ঘ। ওটা যদি আরো সংক্ষিপ্ত হতো তাহলে কবিতাটি আরো ভালো হতো।

আমার কাছে অবশ্য এর দীর্ঘতাই বেশি আকর্ষণীয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে আপনার আবেগ বা ধারণা কী?

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ক্ল্যাসিকধর্মী কবি। কিন্তু তিনিই প্রথম বাঙলা কাব্যে নাস্তিবাদকে রূপায়িত করেন। আমরা জানি না মৃত্যুর পর কী আছে। জীবনের আগে কী ছিলো এবং জীবনের পরে কী আছে- দুটোই অন্ধকার, মাঝখানে যে বেঁচে থাকে এটাই হলো বড়ো ব্যাপার। কিন্তু তার মধ্যে যে নাস্তিবাদ, সেটাই হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। এটাই মনে হয় আধুনিক চৈতন্যের একটি বিশেষ দিক যেটা তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। এদিক থেকে তিনি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কবি।

বুদ্ধদেব বসুকে অনেকেই তেমন গুরুত্বপূর্ণ কবি ব’লে গণ্য করেন না। আমার নিজের ধারণা বুদ্ধদেব বসু এতো কিছু লিখেছেন ব’লেই তাঁর অবমূল্যায়ন চলছে। আপনি কি এমন কোনো ধারণা পোষণ করেন?

আমি মনে করি বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের পর সবচে উজ্জ্বল সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব। প্রতিভায় হয়তো তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করা চলবে না, কেউ করবেও না, কিন্তু নানা ক্ষেত্রে তাঁর যে-অবদান সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁর স্থান হবে, বহুমুখি লেখার স্রষ্টা হিশেবে।

রবীন্দ্রনাথ এবং তিরিশের এই পাঁচজনের যদি তুলনা করি, তবে কোন কবিতাগুলো আপনার কাছে আর্কষণীয় মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতা না এ-পাঁচজনের কবিতা?

রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ, কিন্তু আমাকে বেশি আকর্ষণ করে তিরিশের পাঁচজন কবির কবিতা।

কেনো?

যে-ধরনের বোধ এবং চিন্তা আমার মধ্যে কাজ করে, পৃথিবী, পারিপার্শ্বিকতা এবং আধুনিকতা সম্পর্কে আমার নিজস্ব যে-ধারণা সেটা আমি পাঁচজনের কবিতায় পাই বেশি ক’রে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমার সব অনুভূতির প্রকাশ নেই। অবশ্য আমি তাঁর গানের কথা বলছি না।

এর অর্থ কি তিরিশের পাঁচজনের কবিতা রবীন্দ্রনাথের কবিতার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর?

না আমি শ্রেষ্ঠতর বলবো না। কিন্তু আমার কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক।

কেনো বলবেন না, যদি আসলেই হয়?

আসলে কতগুলো দিকে আছে, যেমন আম এবং কাঁঠাল দুটো আলাদা ফল, কিন্তু আমি বলবো না যে কাঁঠাল আমের চেয়ে ভালো।

এর মধ্যে কোনটি কাঁঠাল এবং কোনটি আম?

উপমাটি বিসদৃশ হয়ে গেলো। উপমাটা ঠিক হলো না। আসলে আমি বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথও প্রাসঙ্গিক, কিন্তু তাঁর চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক তিরিশের এই পাঁচজন কবি।

আপনি কি একটু সন্ত্রস্ত বোধ করছেন সোজাসুজি কথা বলতে? কেননা রবীন্দ্রনাথকে গৌণ করা হ’লে তা বিপজ্জনক হ’তে পারে?

না, তা নয়। কেননা কতকগুলো ব্যাপার থাকে, আমি আগেই বলেছি, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য। আমি কেনো, অনেকেই সে-কথা বলবেন। আমার যেটা মনে হয় শ্রেষ্ঠ ব’লে নয়, তিরিশের কবিরা বেশি প্রাসঙ্গিক, সেজন্যে আমার কাছে আকর্ষণীয়। আমি বলছি না তাঁদের কাব্যমান রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভালো।

রবীন্দ্রনাথের এমন একটি কবিতা বের করুন, যার সঙ্গে অবসরের গান বা যযাতি বা শাশ্বতী’র তুলনা করা যায়।

রবীন্দ্রনাথের দুঃসময় অনেক ভালো কবিতা। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা নয়, সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ এতো বড়ো যে আমার মনে হয় তিনি কবিতা না লিখে যদি শুধু গীতবিতান রচনা করতেন….

গীতবিতানকে আমরা একটু…

ওখানেও কবিতা আছে, গান হয়েও ওখানে প্রচুর কবিতা আছে এবং বিভিন্ন মুড বা আবহের কবিতা আছে, যা খুবই গভীর এবং অন্তর্ভেদী।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমি এখন যখন পড়ি, আমার কাছে অত্যন্ত সরল আবেগের কবিতা ব’লে মনে হয়। কিন্তু ওঁদের কবিতা যখন পড়ি, মনে হয় এতে আছে এমন জটিলতা, যা কৈশোরিকতা, এমনকি তারুণ্যকেও অতিক্রম ক’রে গেছে। এ-জটিলতা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাওয়া যাবে না। আমার মনে হয় এজন্যই হয়তো আপনাকে বেশি আকর্ষণ করে, অর্থাৎ যে-মহান জটিলতা এ-পাঁচজন কবির মধ্যে রয়েছে তা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নেই, যদিও রবীবন্দ্রনাথের মধ্যে অন্যরকম আবেগের তীব্রতা রয়েছে, অসামান্য সারল্য রয়েছে।

তাঁর যে-শব্দসৃষ্টি, তাঁর ডিকশন ছন্দের নানা দিকে তাঁর সৃষ্টিশীলতা এমন কি তিনি গদ্যকবিতার প্রথম রচয়িতা-এই যে নানা দিকে তাঁর আবিষ্কার এ-গুলোকে অবশ্য তাঁর মাহাত্ম্যের উপদান হিশেবে ধরতে হবে।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা কি আসলেই গদ্যকবিতা?

এক ধরণের গদ্যকবিতা তো বটেই, যদিও মধ্যে মধ্যে সেখানে পদ্যের ঢং এসে গেছে, তবু তা গদ্য কবিতা তো বটেই।

আপনার কি মনে হয় এমন কখনো হ’তে পারে যে সাহিত্য এবং কবিতা সম্পর্কে নতুন মূল্যায়নের ফলে রবীন্দ্রনাথের কবিতার মূল্য কিছুটা কমতে পারে, তিরিশের কবিদের কবিতা অনেক বেশি মূল্য পেতে পারে?

এটা নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ওপর। আমার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেসব ব্যাপার আছে, সেগুলো আমাকে আকর্ষণ করে না এমন নয়, তবে রবীন্দ্রনাথ প্রাসাঙ্গিক আমার কাছে, কিন্তু তিরিশের পাঁচজন কবি বেশি প্রাসঙ্গিক।

প্রাসঙ্গিক বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

আমি যে-মানুষ, আমার যে-চাহিদা, আমার যে-অনুভূতি, চিন্তা, তার প্রতিফলন আমি তাঁদের মধ্যে পাই। এদের অবলম্বন ক’রে মনে হয়, আমার নতুন একটা পথে যাবার সম্ভাবনা আছে; এবং সেটা, আপনি যেটা বলেছেন, জটিলতা বলুন, জীবনের অন্ধকার দিক, যেখানে ইহ-জাগতিকতাও আছে এবং করো কারো মধ্যে যেমন অমিয় চক্রবর্তীর মধ্যে কিছুটা আধ্যাত্মিকতাও আছে, অবশ্য অন্যভাবে, বেশি বৈচিত্র্যময় মনে হয় আমার কাছে।

আমাদের উপন্যাস কিছুটা পিছিয়ে আছে ব’লে কি মনে হয়?

হু, কিছু।

কতোটা?

পাশ্চাত্যের ঔপন্যাসিক কাফ্কা, মান, দস্তয়েভস্কি-এদের প্রভাব কিন্তু বাঙলা উপন্যাসেও আছে। এখন ঠিক দস্তয়েভস্কির মানসম্পন্ন ঔপন্যাসিক বাঙলা সাহিত্যে পাবো না। এমনকি কাফ্কার সমমানের ঔপন্যাসিকও পাবো না। তবে এদের প্রভাব কিছু কিছু উপন্যাসে আছে। সেগুলো বেশ লক্ষ্যণীয়, এবং বাঙলা কথা সাহিত্যকে সেগুলো সমৃদ্ধ করেছে বলে আমার ধারণা।

বাঙালি মুসলমান ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

অবশ্যই এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখা, শওকত ওসমানের দু-একটা বই, রশীদ করীমের উপন্যাস আমার ভালো লাগে। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে মাহমুদুল হক এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ভালো লেগেছে। যাদের কথা বললাম তাদের লেখার মান বেশ উঁচু। অনেক সময় আমরা আমাদের কথা সাহিত্যকে একটু অবহেলার চোখে দেখি, সেটা দেখা উচিত নয়।

আপনার নিজের কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাব্যগ্রন্থ কোনটি?

এটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল।

আপনার সমস্ত কাব্যগ্রন্থ থেকে যদি একটিকে রেখে বাকি সবগুলোকে পুড়িয়ে ফেলতে হয়, তাহলে আপনি কোনটি রাখবেন?

‘রৌদ্র করোটিতে’-কেই রাখবো।

আমিও সম্পূর্ণ একমত। আপনি প্রচুর সামাজিক রাজনীতিক কবিতা লিখছেন, কিন্তু আপনার রাজনীতিক কবিতা পড়ে বোঝা যায় আপনি কোনো রাজনীতিক আদর্শে দীক্ষিত নন। আপনি মিছিলে নেমেও অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। আপনার কি তা মনে হয়?

আসলে আমি একটু ভেতর-গোঁজা মানুষ। যদিও আমি নানা অনুষ্ঠানের যাই, নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি, কিন্তু আমি অন্তর্মুখিন। একথা কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, ঠিক আপনারই কথার প্রতিধ্বনি হয় তো হবে যে, আমি সব কিছুর মধ্যে থেকেও যেনো কোনোখানে নেই। আমারও মনে হয়, আমি আসলেই হয়তো সম্পূক্ত হয়েও একেবারে মিশে যেতে পারি না, আমি একটু আলাদাই থাকি।

কেনো ?

আমার মনের গড়নই এরকম। আমি যদি কবি না হতাম তাহলেও বোধ হয় এরকমই হতো।

আপনার প্রেমের কবিতায় আপনি কোন ধরনের আবেগ প্রকাশ করেন? হৃদয়াবেগের ওপর আপনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, না শারীরিক আবেগের ওপর?

দুটোতেই।

শরীর কতোটা ভূমিকা পালন করে?

শরীর তো আছেই। কেননা প্রেম যেখানে আছে, সেখানে শরীর থাকবে, হৃদয় তো শরীরের বাইরের কিছু নয়, ভেতরেরই জিনিশ। যেমন হীরে থেকে যে-দ্যুতি বেরোয় সেটাই হলো আমাদের হৃদয়ের ব্যাপার আর সেই প্রস্তরখণ্ডটি হলো আমাদের শরীর। আমি দেহাতীত প্রেমে বিশ্বাস করি না। তবে শরীরটাই সব নয়। ধরুন, আমি একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছি, তাতেও আমার শারীরিক আনন্দ হতে পারে-যেটাকে স্থুলভাবে কাম বলি। হৃদয়ের ব্যাপারটা দেহে থাকলেও এটা দেহের বাইরের একটা জিনিশ। আমার মনে হয় সেটা আরো গভীর ব্যাপার। প্রেম শুধুমাত্র শরীরনির্ভর নয় এবং শুধুমাত্র হৃদয়নির্ভরও নয়। দুটির মিশ্রণে প্রেমের জন্ম বলে আমি মনে করি। তবে আমার কবিতায় বিভিন্ন ধরনের আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে।

আশা করি আপনার অনেক প্রেমিকা ছিলো। এঁদের মধ্যে কে সবচেয়ে অনুপ্রেরণা দিতে পেরেছে আপনাকে? আপনি কি তার নামটা উল্লেখ করতে পারবেন? প্রথমটি না দ্বিতীয় কিংবা ততীয়টি …

এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয়, আমি সবার কাছেই ঋণী।

এখন যে প্রেমের কবিতা আপনি লিখছেন এগুলো কি কোনো বাস্তব প্রেরণা থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, না কল্পনা থেকে?

কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তব।

যা কিছু আপনাকে সুখি করেছে তার কিছু নাম বলতে পারেন?

আমার পিতামাতার স্নেহ, পরিবারের যত্ন এবং ভালোবাসা, কিছু বন্ধুর প্রেমপ্রীতিশুভেচ্ছা, প্রেমিকাদের সাহচর্য সান্নিধ্য।

প্রেমিকাদের মধ্যে আপনার কি বেশি পছন্দ, তাদের ওষ্ট না কেশগুচ্ছ না …?

তাদের সব কিছুই।

খাদ্য এবং পানীয়ের মধ্যে কোনটি বেশি প্রিয়?

নানা ধরনের, একটিই সবচে প্রিয় এমন বলা যাবে না। পানীয়ের মধ্যে এখন পানিই শ্রেয়। এক সময় যখন আমি মদ্য পান করতান, তখন হুইস্কিই আমার বেশি ভালো লাগতো।

কোনো বিশেষ ধরনের হুইস্কি?

হ্যাঁ, জনি ওয়াকার, ব্ল্যাক লেবেল।

আমরা যে-সমাজে বাস করি তাকে রুদ্ধ সমাজ বলা যায়। সমস্ত কিছু এখানে নিষিদ্ধ। এ-নিষিদ্ধ রুদ্ধ সমাজে বাস করার যে একটা যন্ত্রণা আছে, সেটা কি আপনি বোধ করেছেন?

সেটা আমি বোধ করেছি। আমার মনে হয় সেটা আমার কবিতার ভিতরে কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে। আমি আগেই বলেছি আমাদের সমাজ আদর্শ সমাজ নয়। সব সময় নিষেধের বেড়াজালে আছে। পাশ্চাত্যের জাগতে যেটা প্রায় নেই বলেই চলে। ওখানে একজন মানুষ নিজের মতো ক’রে চলতে পারে, তাকে বাধা দিলেও সে যদি পছন্দ করে তবে সে-রাস্তায় থাকতে পারে। তাকে যদি বাসায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয় তবে সে মামলা করে মামলায় জিতেও যেতে পারে। এইটা আমি যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি। যেখানে নিষেধ বেশি সেখানে অমান্য করার প্রবণতা বাড়ে। যারা সে-নিষেধ মানতে চায় না, তাদের শাস্তি দেয়া হয়। এতে মানুষের অধিকার খর্ব হয়, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যক্তিমানুষ বিকশিত হ’তে পারে না।

আপনি কি মানুষ হিশেবে অভিজ্ঞ না অভিজ্ঞতার পরিমাণ আপনার কম?

আমার তো মনে হয় আমার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট হয়নি।

দরিদ্র জীবন বা মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে কিনা, বা ঢাকা শহরের বাইরে কখনো গিয়ে খুব ঘনিষ্ঠভাবে তাদের জীবন দেখেছেন কিনা?

আমি নিম্ন মধ্যবিত্তকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। তবে সর্বহারা বলতে যাদের বোঝায় তাদের সঙ্গে বসবাস করিনি, তবে যতোটুকু দেখেছি তাতে বলা যায় আমার এক ধরনের পরিচয় তো আছেই আমি বুঝতে পারি নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রা থেকে তাদের জীবন কত দুঃসহ।

ষাটের, সত্তরে বাঙলাদেশের কবিতা কি আপনি পড়েছেন?

ভালোভাবেই পড়েছি।

একালের কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

ষাটের দশকে বেশ ক’জন ভালো কবি রয়েছেন। সত্তর দশকের কবিরা কিছুটা নিষ্প্রভ ষাটের তুলনায়।

একটি অভিযোগ বার বার ওঠে এখন যে সমস্ত রচনা কবিতা নামে চলছে, তার অধিকাংশই কবিতা নয়, অর্থাৎ কবিতার দুর্দিন চলেছে ব’লে মনে হচ্ছে। আপনার কি তা মনে হয়?

এই অভিযোগ আংশিক সত্য। অবশ্য কিছু কিছু ভালো লেখা হচ্ছে। আশির দশকের কিছু কবি চেষ্টা করছেন নতুন কবিতা লেখার, তাদের চেষ্টা এবং সাফল্যের মধ্যে হয়তো এখনও ব্যবধান আছে, কিন্তু আমার মনে হয় যদি চেষ্টা অব্যাহত থাকে, তবে এরা নতুন কবিতা লিখিতে সফল হবেন।

আমাদের সামাজিক রাজনীতিক যে-আলোড়ন চলছে দীর্ঘ দিন ধ’রে তার ফলে কবিতার বেশ ক্ষতি হয়েছে ব’লেই অনেকে মনে করেন, আমিও মনে করি ক্ষতি হয়েছে। আপনার কী মনে হয়?

হ্যাঁ, ক্ষতি হয়েছে। বক্তব্যটাই প্রধান হয়ে উঠেছে অধিকাংশ সময়, শিল্পের দিকটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। সরাসরি কথা বলতে গিয়ে কবিতায় কাঙ্খিত ইঙ্গিতময়তা অনেকের মধ্যেই থাকে না, বাক্সময় হয়ে ওঠে না, মনে হয় যেন সংবাদ পড়ছি কিংবা সম্পাদকীয় পাঠ করছি।

আপনার একটি কাব্যগ্রন্থ’র নাম ‘মঞ্চের মাঝখানে’। আপনি কি এখন মঞ্চের মাঝখানে অবস্থানেই বেশি পছন্দ পান?

মোটেই না। ওই কবিতাতেই আছে যে আমি মঞ্চের মাঝখানে থাকতে চাই না, অনেক সময় ঠেলে দেয়া হয, এ-অবস্থা থেকে আমি পরিত্রাণ চাই।

শামসুর রাহমান, আপনাকে আবার শুভেচ্ছা জানাই। আমরা দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম, এতো দীর্ঘক্ষণ ধ’রে কথা বলার আর সুযোগ আমাদের হবে কিনা জানি না। তবে এ-ভোরবেলা আর মধ্যাহ্ন আমাদের চমৎকার কেটেছে। আমি আশা করি আপনি দীর্ঘজীবী হবেন, আমাদের জীবন আরো অন্তত দু-দশক আনন্দে অতিবাহিত হবে, আপনার কবিতা আরো বিকশিত হবে। এতোটা সময় দেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।

আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনি অনেকক্ষণ ধরে প্রশ্ন করেছেন, আমার উত্তর জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সেজন্যে ধন্যবাদ জানাই। আমি মনে করি যদি আমি আরো বাঁচি, তাহলে আপনারা যারা আমার পরবর্তী প্রজন্মের লেখক- কবি, তাঁদের সঙ্গে আমার যে সদ্ভাব আছে, তা ভবিষ্যতেও থাকবে। অন্তত আমার পক্ষ থেকে কোনো বাধার সৃষ্টি হবে না। আমি বার বার নতুন প্রজন্মের লেখকদের প্রতি আকৃষ্ট হই, বিশেষ ক’রে আমি সব সময় তরুণ লেখকদের, কবিদের সঙ্গ কামনা করি। তাঁরা আমাকে ত্যাগ করবেন না, এই প্রত্যাশা রইলো ধন্যবাদ। সুত্রঃ কথা বলি



মন্তব্য চালু নেই