পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েও যারা বদলে দিয়েছে আজকের বিশ্বকে

সফলতার জন্য শিক্ষা অবশ্যই জরুরী। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা এতই মেধাবী যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছেন নিজেদের সফলতার পথ। স্কুল বা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন বলে তাদের বলা হয় স্কুল ড্রপার। আসুন জেনে নিই এমন ১০ জন স্কুল ড্রপারদের কথা, পরবর্তীতে যাদের কাজ বদলে দিয়েছে আমাদের সবার জীবনযাত্রা।

টমাস আলভা এডিসন

বৈদুতিক বাতি আর ফোনোগ্রাফ আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনকে চিনি আমরা সবাই। বিশ্বাস না হলেও সত্য, ভীষণ মেধাবী এই ব্যক্তি ছোটবেলায় স্কুল পালিয়েছিলেন। সবাই মনে করতেন পড়াশোনা তার দ্বারা হবে না ! কিন্তু সেই এডিসনই ইতিহাসের সবচেয়ে জ্ঞানী বিজ্ঞানীদের অন্যতম একজন বলে বিবেচিত, যার নিজের নামে ১,০৯৩টি মার্কিন পেটেন্টসহ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির পেটেন্ট রয়েছে। গণযোগাযোগ খাতে বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ খাতে তার বহু উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার অবদানের জন্য তিনি সর্বজন স্বীকৃত। যার মধ্যে একটি স্টক টিকার, ভোট ধারনকারী যন্ত্র, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারী, বৈদ্যুতিক শক্তি, ধারণযোগ্য সংগীত এবং ছবি। বাসস্থান, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা কারখানায় বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ও বন্টনের ধারনা এবং প্রয়োগ দুটিই এডিসনের হাত ধরে শুরু হয় যা আধুনিক শিল্পায়নের একটি যুগান্তকারী উন্নতি। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন দ্বীপে তাঁর প্রথম বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়।

বিল গেটস

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তিদের একজন, সবচেয়ে সফল কোম্পানির একটি মাইক্রোসফট যার সৃষ্টি তিনি কিনা স্কুল ড্রপার! তিনি হার্ভার্ড ছাড়েন ১৯৭৩ সালে এবং এক বন্ধুর সাথে একত্রে মাইক্রোসফট কোম্পানি শুরু করেন। হার্ভার্ড ছাড়ার ৩০ বছরেরও বেশী সময় পরে কলেজটি তাকে ডিগ্রী প্রদান করে সম্মাননা হিসেবে। তার সম্মাননা অনুষ্ঠানে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমার প্রভাব খুব খারাপ। তাই আমাকে আপনাদের গ্রাজুয়েশন শেষে বলতে ডাকা হয়েছে। আমি যদি আপনাদের কলেজের প্রথমদিন বক্তব্য দিতাম তাহলে খুব কম মানুষই আজ এখানে উপস্থিত থাকতেন!’ একাধারে ১৩ বছর যাবৎ তিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি ছিলেন।

স্টিভ জবস
ম্যাক, আইপড এদের অস্তিত্বই সম্ভবত থাকত না যদি স্টিভ জবস নিয়মিত স্কুলে যেতেন! তিনি রিড কলেজ ছাড়েন মাত্র ৬ মাস পর কারণ তার বেতন বাকি পড়ে গিয়েছিল। কলেজ ছেড়ে তিনি বরং এগিয়ে যান, সৃষ্টি করেন আজকের অ্যাপল, নেক্সট কম্পিউটার এবং পিক্সার, যে কিনা মর্ডান জীবনযাপন আর সংস্কৃতির চিত্রই বদলে দিয়েছে। তাকে পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ বলা হয়। বিল গেটস আর ওয়াল্ট ডিজনির নাম বিবেচনায় রেখে বলা যায় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রগতিশীল,প্রভাবশালি, প্রতিভাবান আর সফল প্রযুক্তিক ভাবনার অধিকারী ছিলেন স্টিভ জবস | তিনি স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন-এর সাথে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি পিক্সার এ্যানিমেশন স্টুডিওস-এরও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট

আমেরিকার সবচেয়ে আলোচিত আর্কিটেক্ট ফ্রাঙ্ক লয়েড বেশির ভাগ সময় পার করেছেন ডিজাইন করে, কলেজে ক্লাশ করার বদলে! তিনি ১৮৮৬ সালে উইসকনসিন-মেডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং মাত্র ১ বছর পর ছেড়ে দেন। তিনি শিকাগোতে চলে যান এবং লুইস সুলিভানের (মর্ডানিজমের জনক) শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেন। তার সিভিতে ৫০০টির ও অধিক কাজের উল্লেখ পাওয়া যায়।

বাকমিনস্টার ফুলার

তিনি একইসাথে একজন আর্কিটেক্ট, চিন্তাবিদ, আবিষ্কারক এবং কলেজ ড্রপার! তিনি একবার নয় দুই দুই বার হার্ভার্ড ছাড়েন। ”মানবতা স্থায়ী ও সফলভাবে টিকে থাকবে কি না এবং যদি থাকে, তবে তা কেমন করে?”- এ প্রশ্নটি নিয়ে ফুলার সারাজীবন ভেবেছেন। নিজেকে একজন গড়পড়তা সাধারণ মানুষ, যার বিশেষ কোনো টাকা-কড়ি বা শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই বিবেচনা করে তার জীবন এই প্রশ্নটির উত্তর-সন্ধানে নিয়োজিত করেছিলেন। মানুষের উন্নয়নে বড় বড় সংগঠন, সরকার এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ যেখানে অক্ষম, সেখানে একক সত্ত্বা কী করতে পারে তা সন্ধানে তিনি প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

তার জীবনব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষার যাত্রায় তিনি তিরিশাধিক পুস্তক রচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি অসংখ্য উদ্ভাবনের সাথে জড়িত ছিলেন, মূলতঃ নকশা ও স্থাপত্য ক্ষেত্রে, যার মধ্যে প্রধানতমটি ছিলো জিওডেসিক গম্বুজ। জিওডেসিক গম্বুজের সাথে সাদৃশ্যের জন্যে ফুলারিন অথবা বাকিবলস নামক কার্বন অণুর নামকরণ করা হয়েছে তার নামানুসারে।

জেমস ক্যামেরন

একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী কানাডীয়-মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও চিত্রনাট্য লেখক। মূলত অ্যাকশনধর্মী ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি বিখ্যাত। এ ধরনের ছবিগুলোতে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তার চলচ্চিত্র নির্মাণের মুখ্য বিষয়বস্তু হল মানুষের সাথে প্রযুক্তির সম্পর্ক। ক্যামেরন বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্র টাইটানিক রচনা, পরিচালনা ও সম্পাদনা করেছেন। মুদ্রাস্ফীতি বাদ দিলে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আয় করা চলচ্চিত্র। তিনি আরো নির্মাণ করেছেন দি টার্মিনেটর ও টার্মিনেটর ২: জাজমেন্ট ডে এবং এভাটার। এই সফল মানুষটিই কলেজ ড্রপ করেছেন, পড়াশোনা শেষ না করেন নি। বরং একজন ওয়েট্রেসকে বিয়ে করে ট্রাক ড্রাইভারের জীবন বেছে নিয়েছিলেন।

মার্ক জাকারবার্গ

বেশিরভাগ স্কুলছাত্ররা ক্লাশে গল্প করে, ঘুমিয়ে, পড়াশোনা করে অথবা এমন কাজ করে কাটায় যা তারা বাবা মা এর সামনে করতে পারে না। জাকারবার্গ ক্লাশে বসে ডিজাইন করলেন ফেসবুক! প্রথমে শুধু হার্ভার্ডের ছাত্রদের জন্য করা হলেও এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি ধীরে ধীরে অন্যান্য কলেজ এবং পরে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক যতই জনপ্রিয় হতে থাকে ততই জাকারবার্গ নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন পড়াশোনা থেকে। হার্ভার্ডের ছাত্রহল ছেড়ে তিনি চলে যান ক্যালিফোর্নিয়া। তার এই সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল আজ আমরা সবাই তা জানি। ফোর্বস ম্যাগাজিন এর মতে, তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নিয়ার।

টম হ্যাঙ্কস

তিনি হলেন মার্কিন অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি বিগ(১৯৮৮), ফিলাডেলফিয়া (১৯৯৩), ফরেস্ট গাম্প (১৯৯৪), অ্যাপোলো ১৩ (১৯৯৫), সেভিং প্রাইভেট রায়ান, You’ve Got Mail (উভয়ই ১৯৯৮), কাস্ট এওয়ে(২০০০), দ্য দা ভিঞ্চি কোড (২০০৬), ক্যাপ্টেন ফিলিপস, এবং সেভিং মি. ব্যাংক্স (উভয়ই ২০১৩) চলচ্চিত্রে তার চরিত্রের জন্য, এবং পাশাপাশি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র দ্য পোলার এক্সপ্রেস (২০০৪) এবং টয় স্টোরি ধারাবাহিকে তার কন্ঠ প্রদানের জন্য পরিচিত। অভিনয়ের জন্যই তিনি কলেজ ছাড়েন এবং সেক্রেমেন্টো স্টেট কলেজ এর মতে তিনি এই কলেজের সবচেয়ে সফল ড্রপ আউট।

হ্যারিসন ফোর্ড

Star War এবং Indiana Jones খ্যাত হ্যারিসন ফোর্ড রিপন কলেজে দর্শনের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু গ্রাজুয়েশনের আগেই তিনি কলেজ ত্যাগ করেন। প্রথমে তিনি হলিউডের সিনেমায় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করতেন। কিন্তু এতে তিনি এতই অসন্তুষ্ট ছিলেন যে তার চেয়ে প্রফেশনাল কারপেন্টারের কাজ করাই শ্রেয় মনে করেন। ১০ বছর পর ১৯৭৩ সালে কো-স্টার হিসেবে কাজ করেন জর্জ লুকাসে এবং তার সফলতার পথ এসে মেশে ১৯৭৭ এ Star War এ।

লেডি গাগা

স্টেফানি জোয়ান অ্যাঞ্জেলিনা গারমানোটা যিনি লেডি গাগা হিসেবে বেশি পরিচিত, তিনি একজন মার্কিন পপশিল্পী। বিচিত্র ফ্যাশনের জন্য তিনি বেশ আলোচিত। গানের পাশাপাশি এইডস ও বন্যার্তদের সহযোগিতাসহ নানা ধরনের সামাজিক কাজে যুক্ত তিনি। ২০১৩ সালের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস-এর ৪৫ বছরের কমবয়সী সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন লেডি গাগা। তিনি নিউ ইয়র্ক আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। কিন্তু মাত্র ১ বছরের মাথায় ছেড়ে দেন শিল্পী ক্যারিয়ারে পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে।



মন্তব্য চালু নেই