ফরমালিন বিরোধী অভিযান খুব শিগগির

দেশে হঠাৎ করেই খাদ্যে বিষাক্ত ফরমালিন ব্যবহার আবার বেড়ে গেছে।

কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে ফরমালিন অনেকটা সহজ লভ্য হয়ে যাওয়ায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন খাবারে এ বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রণ করে বিক্রি করছে। ফলে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে চলছে। এ অবস্থায় খুব শিগগির বানিজ্য মন্ত্রণালয় ফরমালিন বিরোধী অভিযানসহ কঠিন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি গোচর হয়েছে। অনেক দিন ধরে ফরমালিন বিরোধী অভিযান বন্ধ থাকায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন ধরনের ফল, সব্জি, মাছ, মিষ্টি, দুধসহ বিভিন্ন ধরনের খাবারে ফরমালিন মেশাচ্ছে।

এ বিষয়ে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫ এবং ফরমালিন (আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রয় ও ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

সূত্র জানায়, দেশে বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষাগারে, আসবাব শিল্পে ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট কাজে ফরমালিন ব্যবহারের চাহিদা মাত্র ১০০ টন, অথচ দেশে আমদানি করা হয় ৫০০ টন। এ ছাড়া বিভিন্ন নামে বিপুল পরিমান ফরমালডিহাইড আমদানি হয়। এক শ্রেণির অসাধু আমদানিকারক অতিরিক্ত ফরমালিন আমদানি করে খোলাবাজারে ছাড়ে বলেই এর অপব্যবহার হচ্ছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে যেসব রং ব্যবহার করা হয়, তা স্বাস্থ্যসম্মত কি না, তা-ও পরীক্ষা করে দেখা দরকার। অতিমুনাফার লোভে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যে নির্বিচারে আসবাবপত্রে যে রং ব্যবহার হয় তা মেশায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফলের দোকানে ও বাজারে থেকে বিভিন্ন ধরনের ফল সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে তাতে ফরমালিন ও কার্বাইডের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। নগরীর রমনা, লালবাগ, মিরপুর, তেজগাঁও, মতিঝিল, ওয়ারী, গুলশান ও উত্তরা এলাকার বাজার ও দোকান থেকে এসব ফল সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করে মাল্টায় ২ দশমিক ৭০ থেকে ৮ দশমিক শূণ্য ৮ পিপিএম, আপেলে ৯ দশমিক শূণ্য ২, আনারসে ২ দশমিক ৩০ থেকে ১২ দশমিক শূণ্য ৮, কলায় ২ দশমিক ১০ থেকে ৪ দশমিক ৩৪, আঙ্গুরে ১ দশমিক ২৬ থেকে ৭ দশমিক ২০, চেররি ফলে ৫২ পিপিএম মাত্রায় ফরমালিন পাওয়া যায়। বিশেষ করে আমদানি করা ফলে বেশি মাত্রায় ফরমালিন মেশানোর প্রমাণ মেলেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফরমালিন অত্যন্ত বিষাক্ত বলে নিয়মিত ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার হওয়ার আশংকা থাকে। এছাড়া ফরমালিন খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলীর ক্ষতি করে, লিভারের এনজাইমগুলোকে নষ্ট করে এবং কিডনির কোষ নেফ্রনগুলোকে ধ্বংস করে। ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার বাড়ে, লিভার ও কিডনির নানা রকম জটিল ও দুরারোগ্য রোগ দেখা দেয়। মহিলাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করলে মাসিক ঋতুস্রাবের সমস্যা দেয়। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফরমালিন আরো ক্ষতিকর, অন্যান্য সমস্যা ছাড়াও এর কারণে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হয়। বিশেষ করে শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

সূত্র জানায়, দেশে নিরাপদ খাদ্য আইন রয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ দেশব্যাপী কার্যকর হয়েছে। এর ফলে ১৯৫৯’ একইসঙ্গে রহিত করা হয় তবে রহিত অধ্যাদেশের অধীনে অনিষ্পন্ন কার্যক্রম, দায়েরকৃত মামলা ও তার আপিল আগের অধ্যাদেশের অধীনেই চলছে। উক্ত অধ্যাদেশের অধীনে স্থাপিত বর্তমান আইনের অধীনে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ হিসেবে কাজ করছে। সারাদেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত নির্ধারণ প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ এর অধীনে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার জন্য আইনটিকে ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’ এর তফসিলভুক্ত করার কার্যক্রম নেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, আগের অধ্যাদেশে কোন ব্যক্তি অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদক, প্রক্রিয়াকারী বা বিক্রেতার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারত না। বর্তমান আইনে যে কোন ব্যক্তি মামলা দায়েরের জন্য কারণ উদ্ভব হবার ৩০ দিনের মধ্যে, নিরাপদ খাদ্য বিরোধী যে কোন কার্য সম্পর্কে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারছেন। বর্তমান আইনে ২৩টি বিভিন্ন অপরাধে এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা চার লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা অর্থ দন্ডের বিধান রয়েছে।

এই আইনে খাদ্য দ্রব্যে বিষাক্ত উপাদান (ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, সোডিয়াম সাইক্লামেট, ডিডিটি, পিসিবি ইত্যাদি), তেজস্ক্রিয় ও ভারী ধাতুর ব্যবহার, ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যোপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিপণন, নিম্নমানের খাদ্য উৎপাদন, অনুমোদন বিহীন খাদ্য সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়াকরণ সহায়ক দ্রব্যের ব্যবহার, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য আমদানি, মজুদ, সরবরাহ বা বিক্রয়, অনুমোদিত মাত্রার বাইরে বৃদ্ধি প্রবর্ধক, কীটনাশক, বালাইনাশক বা ঔষধের অবশিষ্টাংশ, অনুজীব ইত্যাদির ব্যবহার, অনুমোদন বিহীন বংশগতি বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকৃত খাদ্য, জৈব খাদ্য, অভিনব খাদ্য ইত্যাদির উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

আগামী ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি ফরমালিন আমদানি ও ব্যবহারের সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করা হবে। একই সঙ্গে ফরমালিন বিরোধী অভিযানকে প্রয়োজনে আরো বেগবান করার বিষয়ে আলোচনা হবে। বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, শিল্প সচিব এবং স্বাস্থ্য সচিব থাকবেন।



মন্তব্য চালু নেই