ফসল কাটা উছিলা, সাঁওতাল উচ্ছেদের নির্দেশনা ছিল!

আখ কাটায় বাধা দেওয়ায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বলে প্রশাসনের পক্ষে দাবি করা হলেও চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘শান্তিপূর্ণ’ উচ্ছেদ অভিযানের নির্দেশনা আগে থেকেই ছিল। অবৈধভাবে বসবাসকারী এই লোকজনকে অনেক আগে থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রতিরোধের মুখে সম্ভব হয়নি। আর জেলা প্রশাসন বলছে, কোনও অভিযান হয়নি। আর স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘ফসল কাটা উছিলা মাত্র, সাঁওতালদের উচ্ছেদের নির্দেশনা ছিল। এই হামলা পরিকল্পিত।’

এদিকে গত রবিবার এলাকার সন্ত্রাসী ও পুলিশি পাহারায় সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ভিডিও থাকার পরও পুলিশ বলছে, পুলিশের উপস্থিতিতে কিছু হয়নি, অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়েছে। কারখানা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রশাসন ও পুলিশের ত্রিমুখী হামলা মামলায় গত তিনদিন গ্রেফতারের আতঙ্কে জয়পুর ও মাদারপুরের পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।

মঙ্গলবার সরেজমিনে এলাকায় হাজির হয়ে দেখেন, খামারের জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলার কাজ শুরু করেছে চিনি কল কর্তৃপক্ষ। সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির পরিদর্শকরা জানান, ‘পুলিশের উপস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ড ও হামলার স্থানে হালচাষ করে হামলার সব আলামত নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।’

খামারের জমির মীমাংসা না করেই সেই ক্ষেত কেন কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলা হচ্ছে—জানতে চাইলে রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল আউয়াল বলেন, ‘অনেক আগেই কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া উচিত ছিল। সেই কাজটি না করার কারণেই খামারের জমি দখল হওয়া শুরু হয়েছে। তাই আমাদের উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হয়েছে।’ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে কে নির্দেশ দিয়েছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত ১ জুলাই হুট করেই ঘরবাড়ি তোলেন সাঁওতালরা। তাদের তীর-ধনুকের সামনে আমরা বেশ কয়েকবার নিরস্ত হয়েছি। ৬ নভেম্বর সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করায় ঘটনাটা হঠাৎ ভিন্নদিকে মোড় নিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিল শান্তিপূর্ণ উচ্ছেদ অভিযানের।’ নির্দেশ কে দিয়েছিল—এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় এমপিকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।’

যদিও জেলা প্রশাসক আব্দুস সালাম বলেন, ‘কোনও উচ্ছেদ অভিযান হয়নি। তবে ওখানকার বিষয়ে সুগারমিলের পক্ষ থেকে কয়েকবারই জানানো হয়েছে।’ এদিকে, গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘ওখানে কারা কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে, এ বিষয়ে আমরা জানি না।’ দু’দিন আগে যেখানে হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে, আগুনে ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে এভাবে আলামত নষ্ট করা যায় কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।’ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পুলিশের উপস্থিতিতে আগুন লাগানো হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য নয়, আগুনের কথা শুনে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল।’

এদিকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গঠিত সংহতি কমিটির পক্ষে দাবি করা হচ্ছে, ‘দেশের প্রচলিত আইন মেনে অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। এছাড়া অভিযানে ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম ছাড়া পুলিশ গুলি চালাতে পারে না। কিন্তু সেখানে কয়েক রাউন্ড গুলি চালানো হলে দু’জন ব্যক্তি নিহত হন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন।

গত রবিবার সকালে সংঘর্ষ ও বিকালে ইক্ষু খামারের ভেতর গড়ে ওঠা প্রায় আড়াই হাজার ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর জয়পুর ও মাদারপুর নামের দু’টি গ্রামে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে সাঁওতাল পরিবারগুলো। ইক্ষু খামার ও গ্রাম দু’টির চারদিকে মোতায়েন রয়েছেন থানা ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের প্রায় ২০০ সদস্য। এছাড়া চিনিকলের কর্মচারী ও তাদের সমর্থক স্থানীয়রাও রয়েছেন। বুধবারও গ্রেফতার আতঙ্কে ওই দুই গ্রামের পুরুষর সদস্যরা বাড়ি ফেরেননি।

এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলের নেতৃত্বে একদল মাস্তান সাহেবগঞ্জে আদিবাসী-বাঙালির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা পল্লিতে প্রায় ৬০০ ঘর ও স্কুলে অগ্নিসংযোগ করেছে। এলোপাথাড়ি গুলি চালানোর কারণে ওই পল্লির বাসিন্দারা সবকিছু ফেলে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেলে তাদের বাড়িঘর লুটপাট করা হয়েছে।’ আহত বিমল কিসকুর স্ত্রীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পুলিশের উপস্থিতেই তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফসল কাটা উছিলা মাত্র, এ হামলা পরিকল্পিত।’

যে জমি নিয়ে সংঘর্ষের শুরু, সেখানে আখের খামার তৈরির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই। চুক্তির ৪ নং শর্তে বলা হয়েছে, ‘যে উদ্দেশ্যে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাছাড়া অন্য কোনও কাজে এ সম্পত্তি ব্যবহার করা যাবে না। যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হলে আগে প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যেন সরকার জমি মুক্ত করে ফেরত দিতে পারে।’

২০০৪ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে লোকসানে থাকা রংপুর চিনিকলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০০৬ সালে মিলটি আবার চালু হলেও সেখানে আখ চাষের পাশাপাশি অন্য ফসল আবাদের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দেয় চিনিকল কর্তৃপক্ষ। এতে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তোলেন স্থানীয় বাঙালি ও সাঁওতালরা। পরে জমির মালিকানা দাবি করে আন্দোলনে নামেন তারা। গত জুনে ওই জমিতে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন স্থানীয়রা। ২০০৬ সাল থেকে গড়ে ওঠা প্রায় আড়াই হাজার ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় গত রবিবার।

সার্বিক বিষয়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ বলেন, ‘১৯৫৬ সালে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। সেজন্য এখানে সাঁওতালদের ফিরে আসার কোনও সুযোগ নেই। আগের ঘটনা না জেনে পরের ঘটনা নিয়ে কথা বললে হবে না। সেখানে কোনও অভিযান চালানো হয়নি।’ যদিও সাঁওতালদের ফিরে আসার সুযোগ নেই—এটি ভুল ব্যাখ্যা উল্লেখ করে ব্যারিসটার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘শর্তে স্পষ্ট বলা যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হলে আগে প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যেন সরকার জমি মুক্ত করে ফেরত দিতে পারে। এই ফেরত দিতে হবে অংশ না পড়ে অর্ধেকটা বললে সত্য বলা হয় না।’খবর বাংলা ট্রিবিউনের।



মন্তব্য চালু নেই