ফাঁসির আগে যা জানিয়েছিলেন সেই বাংলা ভাই: যা এখনো অনেকেরই অজানা

২০০৭ সালের ৩০ মার্চ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শুরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আবদুর রহমান, অপারেশন কমান্ডার আতাউর রহমান সানিসহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর হয় এর আগে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটের শাপলাবাগ এলাকা থেকে শায়খ আবদুর রহমান ও ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলা ভাইকে গ্রেফতারের সময় তারা গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় এ ধরনের দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা গ্রেফতারের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গণমাধ্যমের সামনে তাদের বক্তব্য দিতে দেয়নি। পরে আদালতে বাংলা ভাই এ ব্যাপারে জবানবন্দি দেন। আদালত

এ জবানবন্দি রেকর্ড করে। বাংলা ভাইয়ের ঐ জবানবন্দির একটি কপি সংবাদ মাধ্যমের কাছে এসেছে। জবানবন্দিতে বাংলা ভাই জানিয়েছেন কিভাবে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে, এর পেছনে তত্কালীন গডফাদার কারা এবং অপারেশন চালাতে গিয়ে কাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছিলেন ইত্যাদি। বাংলা ভাইয়ের জবানবন্দিতে বলা হয়, ২০০৩ সালে দিনাজপুরের ছোট গুড়গুলা এলাকায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জেএমবি কর্মী বাদল নিহত হয়। ঐ ঘটনায় পুলিশ শুরা সদস্য খালেদ সাইফুল্লাহ ও এহসার সদস্য হাফেজ হাবিবকে গ্রেফতার করে। তাদের মামলা পরিচালনার জন্য দিনাজপুর আদালতে এডভোকেট গোলাম মোস্তফা চার্লি ও এডভোকেট ওসমান আলীকে নিয়োগ করা হয়। একই বছর যশোরের ঝিকরগাছায় বিস্ফোরক ও অস্ত্রসহ জেএমবির জাহিদুল ইসলাম সুমন ও শহীদুল্লাহ গ্রেফতার হয়। তাদের মামলা পরিচালনার জন্য যশোর আদালতের এডভোকেট এনামুল হক ও এডভোকেট শহীদুর রহমানকে নিয়োগ করা হয়। বাংলা ভাই জানান, ২০০১ সালে জেএমবির রাজশাহী পশ্চিম বিভাগের দায়িত্ব পালনকালে ইসলামী ব্যাংক বগুড়া শাখা থেকে তাদের সংগঠনের টাকা উত্তোলন করা হয়।

ঐ ব্যাংকের একাউন্ট বাংলা ভাই, আব্দুল আউয়াল ও খালেদ সাইফুল্লাহর নামে খোলা ছিল। ২০০৩ সালে খালেদ সাইফুল্লাহ গ্রেফতার হওয়ার পর আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক বগুড়া শাখায় আরেকটি যৌথ একাউন্ট খোলা হয়। ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারি জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের বেগুন গ্রামে চিশতিয়া মাজারে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে খাদেমসহ ৫ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ রাজশাহীর বাগমারায় সর্বহারা নিধনের নামে জেএমবির জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) নামের ব্যানারে তাদের অভিযান শুরু হয়। ২৪ মে পর্যন্ত এই অভিযান চলে। অভিযানে ওসমান বাবু, দীপংকর, শহীদুল, আব্দুল কাইয়ুম বাদশা, খেজুর আলীসহ ৭ জনকে হত্যা করা হয়। অভিযান চলাকালে শায়খ আবদুর রহমান ভারতীয় চর সন্দেহে দুইজনকে প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যা করে। ঐ দুই ভারতীয় বাগমারা এলাকায় পাগল বেশে ঘোরাফেরা করছিল। তারা হিন্দীতে কথা বলতো। বাংলায় কথা বলতে পারতো না বলে তাদের প্রতি জেএমবির সন্দেহ হয়। অভিযান চলাকালে রাজশাহীর তত্কালীন এসপি মাসুদ মিয়া, নওগাঁর তত্কালীন এসপি ফজলুর রহমান ও নাটোরের তত্কালীন এসপি সরাসরি তাদের সহযোগিতা করেছিলেন। জবানবন্দিতে বলা হয়, সর্বহারা নিধন অভিযানের শুরুতে রাজশাহী জেলা

বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শীষ মোহাম্মদের বাসায় তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে তত্কালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের সঙ্গে বাংলা ভাইয়ের মোবাইল ফোনে কথোপকথন হয়। সর্বহারা নিধন অভিযান চলাকালে ব্যারিস্টার আমিনুল হক ছাড়াও তত্কালীন ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, গৃহায়ন ও পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা, শামছুদ্দিন প্রামাণিক ও ডা. ছালেক চৌধুরী ও রাজশাহী সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে সার্বক্ষণিক মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হতো। জবানবন্দিতে বাংলা ভাই আরো বলেন, প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হওয়ার সময় তিনি বহুবার তার বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আলমগীর কবিরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন বুলু একজন সর্বহারা নেতা। আলমগীর কবিরের সম্বন্ধি সাবেক সংসদ সদস্য

ওহিদুল মাস্টারও একজন সর্বহারা নেতা। অভিযান চলাকালে সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা জেএমবির তহবিলে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এ টাকা তিনি পুঠিয়া থানার ওসির মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছে দেন। তত্কালীন ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নাটোরের বাসায় তার সঙ্গে বাংলা ভাইয়ের অন্তত ১০ মিনিট বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় উপমন্ত্রী তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বাগমারা অভিযান চলাকালে তত্কালীন রাজশাহী সিটির মেয়র মিজানুর রহমান মিনু তাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বাগমারা এলাকার সংসদ সদস্য আবু হেনা জেএমবির অভিযানের বিরোধিতা করেন। পরে এলাকার জনসাধারণের চাপে তিনি তার ভাতিজাকে জেএমবির অপারেশনে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। অভিযান চলাকালে রাজশাহী এলাকার সর্বহারা গ্রুপের একটি তালিকা করা হয়। এরা হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন বুলু, বাগমারা শিকদারী হাটের আব্দুস সোবহান, আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন সেন্টু, আলমগীর কবিরের শ্যালক ওহিদুল মাস্টার, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রতন ওরফে তিতাস, গোয়ালকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন, বাগমারার কানা আবুল, আক্কাস, জাহাঙ্গীর চেয়ারম্যানের ভাই আলম, শিকদারী হাটের টিপু মেম্বার,

আজহার মেম্বার, রানীনগরের খোদা বখস, গৌতম শীল, বাগমারার জনি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র আর্ট বাবু, আত্রাইয়ের রবিউল ওরফে তারেক এবং ফজল ওরফে দুর্জয়ের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এদের প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালের ২৪ মে’র পর বাংলা ভাই আত্মগোপন করেন। নওগাঁর আত্রাই থেকে তিনি বগুড়ার নন্দীগ্রাম এলাকায় যান। সেখান থেকে ২ হাজার টাকায় মাইক্রোবাস ভাড়া করে টাঙ্গাইল চৌরাস্তায় পৌঁছেন। টাঙ্গাইল থেকে মোটর সাইকেলে তিনি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় আসেন। মুক্তাগাছায় আসার পরও রাজশাহীর ঐসব নেতাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ ছিল বাংলা ভাইয়ের। তারা জানিয়েছিলেন যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উপরের নির্দেশে তাকে বিদেশ পাঠানো হবে।



মন্তব্য চালু নেই