ফারাক্কার গেট খোলা নিয়ে অপপ্রচারে ‘বিরক্ত’ বাংলাদেশ

ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দিয়ে পানি ছাড়ার খবর ও বন্যার আশঙ্কাটিকে ‘অপপ্রচার’ মনে করছে দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। এই ‘বিভ্রান্তিকর’ খবর কীভাবে মিডিয়াতে এলো তা নিয়েও দিল্লির সরকারি মহলে খোঁজখবর নিচ্ছেন বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা।

এই বিভ্রান্তির সূত্রপাত গত ২৩শে আগস্ট, মঙ্গলবার। সে দিন ‘দ্য হিন্দু’-সহ ভারতের বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শশী শেখরকে উদ্ধৃত করে আরও বলা হয় যে ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে বিহারের পরিস্থিতির বেশ কিছুটা উন্নতি হবে বলেও তারা আশা করছেন।

পরে বাংলাদেশের বেশ কিছু মিডিয়াতে সেই একই খবর ‘লিফট’ করে পুনঃপ্রকাশ হয়। একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই খবর প্রকাশ করে বলা হয় “ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে”।

“আমাদের খটকার শুরু ওখান থেকেই। খটকার কারণ হল, এই বর্ষার মৌসুমে ফারাক্কার সবগুলো গেট এমনিতেই খোলা থাকে – নতুন করে খোলার কিছু নেই। তাই যখন বলা হচ্ছে ভারত ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, তাই আমরা বেশ অবাক না-হয়ে পারিনি”, বলেছেন দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি উচ্চপদস্থ সূত্র।

বস্তুত বর্ষার মরশুমে ফারাক্কার ঠিক কতগুলো গেট খোলা থাকে, তা নিয়েও মিডিয়াতে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে বেশ অসঙ্গতি দেখা গেছে। ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সমীর সিনহাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি যেমন জানায়, বর্ষায় সাধারণত ফারাক্কার ১০৪টি গেটের মধ্যে সত্তর-আশিটা গেট খোলা থাকে। কিন্তু বিহারের বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত ১০০টার মতো গেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে–আর সেটা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে, তাদের আগাম নোটিশ দিয়েই করা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।

কিন্তু দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানানো হয়েছে, “বর্ষার পিক সিজনে ফারাক্কার সবগুলো গেট–অর্থাৎ ১০৪টাই যে খোলা থাকে এটা আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। এটা একটা নিয়মিত রুটিন ব্যাপার, ফলে এখানে পরামর্শ করা বা নোটিশ দেওয়ারও প্রশ্ন আসে না। তা সত্ত্বেও এই খবর বেরোনোর পর আমরা ঢাকাতে খোঁজ নিয়েছি, তারাও বলেছেন দিল্লির সঙ্গে তাদের এ নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি।”

কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মিডিয়াতে এই মর্মে খবরও বেরিয়ে গেছে–‘বিহারকে বাঁচাতে ভারত ফারাক্কা দিয়ে পানি ছাড়ছে, আর তাতে ডুবতে চলেছে বাংলাদেশ!’

“অথচ দেখুন – তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ২৩/২৪ আগস্ট নাগাদ ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, তার পরও তো প্রায় দশদিন হতে চলল। পদ্মায় বাড়তি পানির স্রোতে রাজশাহী বা অন্য কোথাও কি বন্যা হয়েছে বলে খবর এসেছে?” পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

বিষয়টি নিয়ে বিশদে খোঁজখবর করতে গিয়ে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ার ‘নির্দেশে’ রীতিমতো ভেজাল ছিল। ভেজাল, কারণ এখানে নির্দেশ দেওয়ার কিছু নেই, স্বাভাবিক ব্যবস্থাতেই বর্ষার মওশুমে ফারাক্কায় গঙ্গার প্রবাহ অবাধ থাকে–অর্থাৎ সব গেটই খোলা থাকে।

কিন্তু তারপরও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে সে কথা বলতে হয়েছিল স্রেফ বিহার সরকারকে আশ্বস্ত করার জন্য। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার রবিবার ২১শে আগস্ট হেলিকপ্টারে রাজ্যের বন্যাপীড়িত অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করেন এবং তারপর ক্ষোভ উগড়ে দেন ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে।

পরদিনই বিহারের চিফ সেক্রেটারি (মুখ্যসচিব) আনজানি কুমার সিং দিল্লিতে ফোন করেন জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শশী শেখরকে। শশী শেখর তাকে বলেন, “চিন্তা করবেন না, আমরা ফারাক্কার সব গেট খুলে দিতে বলেছি–তাতে গঙ্গা দিয়ে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে গিয়ে বিহারে বন্যার পানি কমে আসবে!”

এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও কোনও রাজ্যের মধ্যে আমলা স্তরে এই ধরনের কথাবার্তা হয়তো খুবই স্বাভাবিক–কিন্তু সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে এই মন্তব্য যে সম্পূর্ণ অন্য অর্থ বহন করতে পারে, সেটা নিশ্চয় দিল্লির কর্মকর্তাদের তখন মাথায় ছিল না। কিন্তু এই মন্তব্য মিডিয়াতে এসেছে, যথারীতি বাংলাদেশেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

গোটা ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার তথা দিল্লিতে তাদের হাইকমিশন যে যারপরনাই ‘বিরক্ত’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থও জড়িত আছে, সে সব বিষয় এখন থেকে দিল্লির সরকারি কর্মকর্তারা যাতে দেশের ভিতরেও একটু ভেবেচিন্তে ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে কথা বলেন, তারা তাদের সেই অনুরোধই জানাচ্ছেন।



মন্তব্য চালু নেই