ফুটপাত নয়, সড়ক মুক্ত করাই চ্যালেঞ্জ দুই মেয়রের

‘উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’- বেহাল অবস্থার উদাহরণ দিতে গিয়ে যখন মানুষ সদরঘাটের চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ প্রবাদটি ব্যবহার করেন তখন এর বিরোধিতা করে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘দেখতে যদি চাও ফিটফাট চলে এসো সদরঘাট।’

সদরঘাট সংলগ্ন আশেপাশের সড়কগুলো নিয়ে গর্বিত মন্ত্রীর মুখ থেকে যখন এমন বক্তব্য শোনা যায় তখনো দেখা গেছে সদরঘাটের আগের চিত্রই। পুরান ঢাকার বাংলাবাজার ওভারব্রিজ থেকে সদরঘাট টার্মিনালের মাত্র তিন মিনিটের সড়কের দু’পাশের ফুটপাতই একেবারে বেদখল হয়ে রয়েছে। এখানে ফুটপাত তো দূরের কথা রাস্তার অর্ধেক জুড়ে বসে থাকে হাকাররা। অথচ নৌপথে যাতায়াত করতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এ সড়কটিই ব্যবহার করেন। ব্যস্ততম এ সড়কে এখন সকাল ১০টা পর থেকে একটানা রাত পর্যন্ত লেগে থাকে যানজট।

শুধু সদরঘাটের এ সড়কটি নয়, একই চিত্র পল্টন, গুলিস্তান, বাবুবাজার হয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক সড়কেও। সড়কটি থেকে ফুটপাত দখল মুক্ত রাখার জন্য ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জনস্বার্থে করা একটি রিটে উচ্চ আদালত জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার নিদের্শনা দেন। এ ছাড়া ওই এলাকায় মূল সড়ক দখল করে রাখা রড, বালু বা যে কোনো পণ্য, ট্রাক, ভ্যানগাড়ি ও ঠেলাগাড়ি পার্কিং বন্ধের নির্দেশনাও দেন আদালত। এর জন্য পল্টন, বংশাল, সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি থানার ওসিদের ২৪ ঘণ্টার সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। এরপর কয়েকদিন তাদের তৎপরতা দেখা গেলেও পরে তাদের আর টিকিটিও মেলেনি। সেই দীর্ঘ সড়কের অবস্থা এখন আগের চেয়েও নাজুক হয়ে পড়েছে। অথচ পুলিশ ও মন্ত্রীর দাবি-এখানে কোনো হকারই নেই।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নেয়ার পর গুলিস্তানে অবৈধ হকার সরানোর জন্য মেয়র সাঈদ খোকন এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ বার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু অভিযানের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর আবার তা বেদখল হয়ে যায়। এতে বিরক্ত মেয়র নিজেই। সম্প্রতি এক সেমিনারে তিনি বলেই ফেললেন- ‘আমরাতো এখন আর ফুটপাত দখলমুক্ত করছি না। অন্তত পক্ষে তারা রাস্তা ছেড়ে দিক।’

হকারদের পক্ষ নিয়ে মেয়র আনিসুল হকও বেশ কয়েকটি সেমিনারে বলেছেন- আমরা চাইলেই মুহূর্তে তাদের উচ্ছেদ করতে পারি। কিন্তু তাদের দিকটাও তো একটু দেখতে হবে। তাদের তো পরিবার পরিজন আছে।’

এসব হাকারদের পক্ষে রয়েছে পুলিশও। গত বুধবার ডিএসসিসির অডিটরিয়ামে যানজট নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে এক যৌথ সভায় ডিএমপি ট্রাফিকের দক্ষিণ জোনের ডিসি খান মো. রেজওয়ান বলেন, ‘আসলে পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ করতে গেলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।’

তবে তার এ বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন অনেকেই। জবাবে মেয়র খোকন বলেন, ‘গুটি কয়েক হকারদের জন্য নগরবাসীর দুর্ভোগ সহ্য করা যায় না। তা ছাড়া আমরাতো ফুটপাতে যাচ্ছি না। তারা অন্ততপক্ষে রাস্তা ছেড়ে দিক।’

তবে হকারদের পক্ষে পুলিশের বক্তব্যের পেছনে রয়েছে ভিন্ন কারণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুটপাতে দোকানভেদে প্রতিদিন ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় পুলিশের লাইনম্যানকে। প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও বিকেলে টহল পুলিশ চাঁদা নেয়। পুলিশ সরাসরি এ টাকা না নিলেও তাদের নিয়োগকৃত লাইনম্যান টাকা সংগ্রহ করেন। যে কারণে বারবার উদ্যোগ নিয়েও সফল হচ্ছে না সিটি করপোরেশন।

হকার্সবান্ধ‌ব পুলিশ ও মেয়রের এমন অবস্থানে ‘সুযোগ’ দেখছেন দখলদার হকাররা। তারা এবার নতুন উদ্যোমে জোরেশোরে ফুটপত দখলে নেমেছেন। এবার ফুটপাতে খালি জায়গা না পেয়ে দখল শুরু করেছেন রাস্তায়ও। ফলে বেকায়দায় পড়েছে খোদ সিটি করপোরেশন।

রাজধানীর ফুটপাতগুলো নিয়ে পরিচালিত বেসরকারি এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকার ৪৪ শতাংশ সড়কেই ফুটপাত নেই। ৭০ শতাংশ ফুটপাত বেদখল। এর মধ্যে ২২ শতাংশের অবস্থা খুবই নিম্নমানের। ব্যবহার উপযোগী ফুটপাত মাত্র ৮ শতাংশ। তবে দুই সিটি নির্বাচনের পর ফুটপাতগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হলেও তার কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

পথচারীদের চলাচলের ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং, দখল করে দোকানপাট বসানো, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ ফুটপাতের বিভিন্ন অপরাধের জন্য মোটরযান আইন, সিটি করপোরেশন আইন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশ অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু যারাই এ শাস্তি নিশ্চিত করবেন তাদের মদদেই চলছে আইন ভঙ্গের মহোৎসব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখন হকাররা ফুটপাত শেষে এবার সড়ক দখলে নেমেছেন।

এ বিষয়ে নগরবিদ মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘সবাই বড়বড় কথা বলে। কিন্তু যারা কথা বলে তারাই যদি অপরাধে জড়িত থাকে তাহলে অপরাধ থামবে কিভাবে। কিছু অসাধু লোক, রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ টাকার বিনিময়ে ইচ্ছাকৃতবাবে ফুটপাতে হকার বসিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।’



মন্তব্য চালু নেই