ফেসবুক লাইভে মেয়েদের অশালীনতা : বাড়ছে হয়রানি

সোমা মন্ডল (ছদ্মনাম)। বয়স ২১। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা ৮০০। ফলোয়ার ২ হাজারেরও বেশি। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা ২৮ মিনিটে ফেসবুক লাইভে আসেন তিনি। পড়নে ছিল হাতকাটা টপস এবং থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট। বন্ধুরা কমেন্ট বক্সে নানা প্রশ্ন করে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেগুলোর উত্তর দেন তিনি। ফেসবুকে ১৩ মিনিট লাইভ করার পর লগ আউট করে ঘুমিয়ে পড়ে সোমা।খবর জাগো নিউজের।

পরদিন সকালে সেই টপস পড়া একটি ছবি দিয়ে সোমার নামে খোলা হয় একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। সোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে শুরু করে সব ধরনের হুবহু তথ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অ্যাকাউন্টটি। তার ফেসবুক লাইভের ভিডিওটি থেকে ৪০ সেকেন্ডের একটি ক্লিপও সেখানে আপলোড করা হয়। তবে ক্লিপটিতে অন্য এক নারীর ভয়েজ দেয়া হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, বিছানায় হেলান দেয়া সোমা ঠোঁট নাড়ছে (লিপ্সিং) আর আরেকটি মেয়ের কণ্ঠে সোমার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি ফোন নম্বর দেয়া হচ্ছে।

খালাতো বোনের ফোন পেয়ে দ্রুত নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করেন সোমা। তবে ততক্ষণে বিষয়টি ফেসবুকের বিভিন্ন অশালীন গ্রুপে ভাইরাল হয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম দলকে অভিযোগ দেয়া হলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সোমা। ভার্সিটির ক্লাসে যাচ্ছেন না, কারো সঙ্গে কথা বলছেন না এমনকি ভয়ে নিজের মোবাইল ফোনটিও বন্ধ করে রেখেছেন তিনি।

সোমার মতো এরকম অনেক মেয়ে ইদানিং সংবেদনশীল অবস্থায় ফেসবুক লাইভ ভিডিও দিচ্ছেন আর অপরিচিত ফলোয়ারদের দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এগুলোর পেছনে মেয়েদের অসাবধানতাকে দায়ী করেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। তবে লাইভে এধরনের খোলামেলা কথা বলা আর পশ্চিমা বিশ্বের কাপড় পড়ে উগ্রতাকেও প্রশ্রয় দিতে নারাজ সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ভিডিও পোস্টের ক্ষেত্রে মেয়েদের জানতে হবে কোনটা সবার সঙ্গে শেয়ার করা যায় আর কোনটা যায় না।

ফেসবুকে লাইভ দেয়ার বিষয়ে কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে কথা বলে হলে তারা লাইভে আসার বিষয়ে কয়েকটি কারণ দেখান। কেউ বলেন, এটি একটি ট্রেন্ড, কেউ ‘মন খুলে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে ফেসবুকে লাইভ দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৫ বছর বয়সী এক তরুণী বলেন, আমাদের বয়সী মেয়েরা পরিবারের জন্য ‘ইউজলেস’। পরিবারে কোন ভূমিকা নেই। তাই বন্ধু-বান্ধবের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য লাইভ ভিডিও করে। এসব মেয়রা উগ্র কাপড় পড়ে কারণ তারা চায় তাদের নিয়ে বন্ধুরা আলোচনা করুক।

লাইভে আসার কারণগুলো হয়তো তরুণীদের কাছে যৌক্তিক। তবে এধরনের ‘তুচ্ছ’ অজুহাতে লাইভে এসে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করে সাইবার নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটানো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার চেয়ে কম নয়।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম ইউনিট জানায়, সাইবার হয়রানির যতগুলো ঘটনা ঘটেছে এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মেয়েদের অসাবধানতা। অধিকাংশ সময় তাদের কাছের বন্ধু বা আত্মীয় দ্বারাই তারা হয়রানির শিকার হয়। মেয়েদের হাতে মেয়েদের হয়রানির ঘটনার প্রমাণও আছে তাদের কাছে।

সম্প্রতি ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় এমনই একটি ঘটনার শিকার হন এক তরুণী। বন্ধু রাজনের সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করায় ওই মেয়ের মা’কে জড়িয়ে ফেসবুকে ভুয়া পোস্ট দেয় সেই বন্ধু।

প্রতিনিয়ত এধরনের ঘটনা ঘটার পরও মেয়েরা কেন সাবধান হচ্ছে না ? কেনই বা সবার সামনে উগ্রভাবে নিজেদেরকে প্রদর্শিত করে বিপদ ডেকে আনছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও সিসিএ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা রাশেদা রওনক খান বলেন, যারা এসব ভিডিও দিচ্ছে তারা তরুণ। তারুণ্যের কিন্তু একটা উত্তেজনা আছে, আনন্দ আছে, তারুণ্যের একটা এক্সপ্রেস করার ভাষা আছে। তারা এক্সপ্রেস করতে চায় সবকিছু। তারুণ্যের বয়সের কাছে আবেগটা ধরে রাখতে পাড়ছে না বলেই এগুলো করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, একটা বয়সে ছেলে-মেয়ে উভয়ই খুব আবেগপ্রবণ থাকে। তারা বুঝে না বুঝে নানা কথা বলে ফেলে। তবে তাদের উগ্র পোশাক পড়া কখনোই কাম্য নয়। পোশাক যদিও ব্যক্তিগত ব্যাপার তবে আমাদের একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আমার সমাজ-সংস্কৃতি অনুযায়ী সেই পোশাকটিই পরতে হবে। পশ্চিমা পোশাক পরতে বাধা নেই। তবে সেটি যেন উগ্র না হয়। আর সেলেব্রিটি ছাড়া পশ্চিমারাও উগ্র পোশাক পরে না।

তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে বাবা-মা’র একটা বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের উচিৎ আগে থেকেই সন্তানকে মূল্যবোধ শেখানো। সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ ব্যবহার করা। কার সঙ্গে কোন কথা বলা যাবে, কোনটা যাবে না এগুলো শেখানো। পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টিতে স্কুল-কলেজগুলোকেও একটি দায়িত্ব পালন করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

সচেতনতার বিষয়ে ড. রওনক আরো বলেন, ফেসবুক লাইভে ভিডিও দিয়ে নিজেেকে এক্সপ্রেস করার আগে এটা জানা জরুরি কোনটা এক্সপ্রেস করা যাবে আর কোনটা যাবে না। কোনটা পাবলিক করা যায় আর কোনটা প্রাইভেট থাকলে ভালো হয় সেটা বুঝতে হবে। মেয়েরা যাতে এক্সপ্রেস করার বর্ডার ক্রস না করে কিছু সচেতনতামূলক কাজ করা দরকার। এবিষয়ে বাবা-মা’র খোঁজ রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে তরুণদের সমস্যা হচ্ছে তারা বাবা-মা’র কথা শুনতে চায় না। তারা কোন বাধা-নিষেধ শুনতে চায় না। তবে এ বিষয়ে তাদের সচেতন হতে হবে। বাবা-মা’র পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবরাও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সাদ সরকার বলেন, ফেসবুকে যে কোন ধরনের হয়রানি করলে সেগুলো তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অপরাধ বলে গণ্য হয়। তবে লাইভের মাধ্যমে নিজেদের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই নিজেদের সাইবার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটি মেয়েকে অপরিচিত অনেকেই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। যদি সেই মেয়েটি তার রিকুয়েস্ট গ্রহণ না করে তবে ফেসবুকের নিয়ামানুসারে ছেলেটি তাকে ফলো করতে পারে। মেয়েটির পোস্টে কমেন্ট না করতে পারলেও তার পোস্ট ও ছবি দেখতে পারে, লাইক-শেয়ার করতে পারে। শেয়ারের মাধ্যমে তাদের অনেক সংবেদনশীল পোস্ট অপরিচিত ফলোয়ারদের হোমে চলে যায়। সামান্য অসাবধানতার কারণে এভাবেই ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়ে যায়। অনেক সময় নিজের বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে এধরনের হয়রানি করে।



মন্তব্য চালু নেই