ফেসবুক সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও সমকালীন বিবর্তন

সাফাত জামিল শুভ : অনেক ক্ষেত্রে ভাল জিনিস আর ভাল থাকে না অপপ্রয়োগের কারণে। ছুরি-চাকু-আগ্নেয়াস্ত্র যা-ই বলুন না কেন, কোনটাই মানুষের ক্ষতির জন্য তৈরি করা হয়নি। সবই মানুষের উপকারের জন্য তৈরি। কিন্তু এর অপব্যবহারের কারণেই বর্তমানে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এজন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত এবং সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ।

প্রতিটি প্রযুক্তিরই উদ্ভাবন হয় কোনো না কোনো মানব কল্যাণের জন্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় মানুষ সেখান থেকে কল্যাণের পরিবর্তে তার অপব্যবহারেই বেশি লিপ্ত থাকে। আমেরিকান কম্পিউটার প্রোগ্রামার মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গসহ পাঁচ বন্ধু মিলে ফেসবুক সাইটটি তৈরি করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই সাইটের মাধ্যমে প্রিয়জন কিংবা বন্ধু-বান্ধব যাদের সাথে সময়ের কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে দেখা সাক্ষাৎ হয়ে উঠে না তাদের সাথে বিশেষ কোনো মুহূর্তের ছবি অথবা অনুভুতিকে শেয়ার করা। কিন্তু আমাদের দেশে এর ব্যবহারের বহুমাত্রিকতার ফলে এর আবিস্কার উদ্দেশ্যের “বিবর্তন” ঘটেছে।

আগে মানুষ কারও বিপদ দেখলে সাধ্যমত তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতো। এখন কেউ রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছে কিংবা পকেটমারকে ধরার জন্য সাহায্য চাচ্ছে এই সময় সাহায্যের পরিবর্তে ঐ দৃশ্যটিকে মোবাইলে ধারণ করার জন্যই ব্যস্ত হয়ে পড়ে কেউ কেউ। কেননা অমন একটা ছবি যদি তোলা যায় আর যদি ফেসবুকে পোস্ট করা যায় তাহলে লাইক আর কমেন্টস দেখে কে!

এতো গেল অন্যের বিপদের কথা। ফেসবুক আসক্তিতে অনেকে নিজের বিপদের কথাও ভুলে যাচ্ছে। বাসের সাথে ধাক্কা লেগে রিক্সা যাত্রী পড়ে গিয়ে পা রক্তাক্ত! কোথায় সে আগে ডাক্তারের কাছে যাবে তা না করে বন্ধুর হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে নিজে প্যান্টটা একটু উচু করে ধরে ছবি তোলে পাঠিয়েছে ফেসবুকে। লাইকের মত একটি অর্থহীন সস্তা বিষয়কে নিজের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ধরে বসে আছেন প্রায় সবাই। লাইক কম হলে মন খারাপও করে ফেলেন অনেকে।

অনেক ছেলে, মেয়েদের ছবি দিয়ে খুলছে নতুন নতুন আইডি। দীর্ঘদিন মেয়ের মতো করে স্ট্যাটাস দেওয়া, মেয়েদের মতো করে কমেন্টস করা এবং মেয়ে সেজে অন্যের সাথে প্রতারণা করতে করতে এর একটা মনস্তাত্বিক বিরূপ প্রভাব পড়তেও পারে সে মানুষটির মাঝে। যা তাকে হয়তো মেয়ে বানিয়ে ফেলবে একথা সত্য না হলেও যদি ছেলে এবং মেয়ের মাঝামাঝি মানসিকতায় রূপ নেয় তাহলেই তো মহা সর্বনাশ! বন্ধুরা হাসছেন?

আমাদের জন্য সবচাইতে ভীতির বিষয় হচ্ছে যারা ফেসবুক ইউজার কিংবা প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম, তারা কিন্তু সমাজের শিক্ষিত ও মেধাবী জনশক্তি।এরই মাঝে আবর্জনা হয়ে আছে তথাকথিত কিছু অনলাইন ফেসবুকভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। সস্তা লাইকের আশায় বিভ্রান্ত ও আজেবাজে তথ্য দিয়ে মিনিটে মিনিটে তারা খবর প্রকাশ করে।

সাম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে- ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীরা বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন।ফেসবুক ব্রাউজ করা আজ লাখো মানুষের দৈনন্দিন কাজের অংশ হয়ে উঠেছে। গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন, কিভাবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে আবেগীয়ভাবে জড়িয়ে আছেন ব্যবহারকারীরা। এছাড়া এর নিত্য ব্যবহার ‘মানসিক স্বাস্থ্যের’ ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তা-ও বের হয়ে এসেছে ঐ গবেষণায়। দেখা গেছে, ব্যবহারকারীদের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারের ফলে অন্য ব্যবহারকারীর প্রতি ‘ঈর্ষা বা হিংসা’র জন্ম নিলে তা থেকে বিষণ্নতাবোধের জন্ম হতে পারে। গবেষণার সঙ্গে জড়িত অধ্যাপক মার্গারেট ডাফি বলেন, যেভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেন ব্যবহারকারীরা, তার ফলে এর প্রতি নিজেদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, যদি ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এর ভাল দিকগুলো বেছে নিয়ে নিজের পরিবার ও পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখেন এবং জীবনের মজার ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন, তাহলে ফেসবুক হতে পারে বেশ মজার ও স্বাস্থ্যকর কর্মকাণ্ডের জায়গা।

তবে পরিচিত কেউ অর্থনৈতিকভাবে কতটা ভাল আছে, বা পুরনো কোন বন্ধু তার সম্পর্ক নিয়ে কতটা সুখে আছে, তা দেখার জন্য যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ঈর্ষা বা হিংসার জন্ম নিতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে ক্রমেই বিষণ্নতাবোধের সৃষ্টি হতে পারে। এ গবেষণার জন্য ৭০০ তরুণ ফেসবুক ব্যবহারকারীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। দেখা গেছে, এদের মধ্যে যারা ফেসবুক অনেকটা ‘নজরদারির’ কাজে ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে বিষণ্নতাবোধের লক্ষণ রয়েছে। অন্যদিকে যারা যোগাযোগ রাখার জন্য ফেসবুক ব্যবহার করেন, তারা এর নেতিবাচক প্রভাবে ভোগেন না। বন্ধুদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কে কতটা ভাল অবস্থানে রয়েছে, এসব দেখতে অনেকে ফেসবুক ব্যবহার করেন। একে গবেষণায় নজরদারিমূলক ফেসবুক ব্যবহার বলে বোঝানো হয়েছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নজরদারির কাজে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে, বন্ধু বা পরিচিত কারও বিলাসী ছুটির দিন, নতুন গাড়ি বা বাড়ি, এমনকি সুখী সম্পর্ক নিয়ে করা ফেসবুক পোস্টের ফলে ঈর্ষা বা হিংসার বোধ জন্মায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, এ বোধের ফলে ক্রমেই বিষণ্নতাবোধের শিকার হন ওই ব্যবহারকারীরা।

অধ্যাপক ডাফি বলেন, অনেক মানুষের জন্য ফেসবুক খুবই ইতিবাচক দিক হতে পারে। কিন্তু অপর একজনের সঙ্গে নিজের জীবনযাপনের তুলনার জন্য যদি ফেসবুক ব্যবহার করা হয়, তাহলে এর খুব নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরনের আচরণ এড়ানোর জন্য ফেসবুক ব্যবহারকারীদের উচিত এসব ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়া।

প্রতিদিনই ফেসবুকে বাড়ছে চেনা-অচেনা অনেক বন্ধু। আর একটা লাইক পেলে ঋনী হয়ে যাচ্ছেন তার কাছে। তাই সেই ঋণ শোধ করতে হচ্ছে তার পোস্টে লাইক দিয়ে কিংবা কমেন্টস করে। আর কমেন্টস-এর উত্তর দেওয়া তো অনেকটা মহাকর্তব্য হয়ে পড়ে।

গত এক শতাব্দী ধরে মানুষের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। ক্রমে তা কল্পনার জগৎকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একের পর এক আবিষ্কার হচ্ছে নানা ধরনের যন্ত্র যা মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে আবার অনেক ক্ষেত্রে তা জটিলও করেছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার একজনকে নয়, একটি পরিবারকে, কখনও একটি সমাজকে বিপথগামী করছে, বিপদগ্রস্ত করছে, নিয়ে যাচ্ছে খাদের কিনারায়। বর্তমানে আগ্নেয়াস্ত্রকেও যেন হার মানিয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। গত শতকের শেষ থেকে ইন্টারনেট মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কেবল যোগাযোগ অনেক সহজ ও কার্যকর করে দিয়েছে তা নয়, বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। অন্তর্জালের (ইন্টারনেট) যুগান্তকারী প্রসারে সবাই আটকা পড়ে যাচ্ছেন মোহময় জালে। এই ‘জালে’ কে কোন চাল চালে তা বোঝা যায় না।

ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের সুবিধা নিয়ে সৃষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের জীবনে সবার অলক্ষ্যেই অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ভাল ফলের সঙ্গে অনেক মন্দ ফলও বয়ে আনছে। বলতে পারেন, ভাল ফলই যদি হয় তবে আর কথা কেন? আসলে নিন্দুকেরা সব কিছুতেই দোষ খুঁজে বেড়ায়। একটা জিনিস বোধহয় মনে রাখা দরকার, তা হলো- কোন জিনিস কারও উপকারে না লাগলেও অসুবিধা নেই, কিন্তু সেটি যদি উল্টো ক্ষতি করে তখন আপনি কি করবেন? নিশ্চয়ই তা রাখবেন না। মাইনাস ওয়ান এর চেয়ে জিরো কি ভাল নয়?

আপনি বলবেন, সবাই তো আর খারাপ নন। কিন্তু কে খারাপ তা তো জানা যায় না। সবাই আর তো চোর বা ডাকাত নন। রাজধানীতে কয়েক লাখ পরিবারে কোটির বেশি লোকের বাস। আর চোর-ডাকাতের সংখ্যা কি লাখ হবে? তারপরও কেন সবাই দরজা বন্ধ করে, তালা এঁটে রাত যাপন করেন। কয়টা ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটে বছরে? কিন্তু তারপরও লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রতিটি শাখায় ভল্ট তৈরি করতে হয়। আসলে নিরাপদ থাকতে চায় সবাই, আমিও- আপনিও। কোন ঝুঁকি নিতে চাই না কেউ আমরা। কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার ঘরের মধ্যে যে চোর বা ডাকাত ঢুকছে সে কিন্তু আপনার আর্থিক ক্ষতির চেয়েও মারাত্মক ক্ষতির কারণ ঘটাচ্ছে। তা নিয়ে কেন মাথা ঘামাবো না। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়ের সুবাদে আজ কতজন নারী তার সম্ভ্রম হারিয়েছে তার হিসাব কোন প্রতিষ্ঠান রাখছে কি-না জানি না। তবে যে পরিবারের মেয়েটি এর শিকার সে এবং তার পরিবার কিন্তু আজীবন এ ক্ষত বয়ে বেড়াবে। বর্তমানে পরকীয়ার কারণে যেভাবে সংসার ভাঙছে তার পেছনে এই ফেসবুক অনেকাংশেই দায়ী। স্মার্ট ফোনও দায়ী। এখন অনেক সুলভে মিলছে আধুনিক ফোন। এর মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহারও অনেক সহজ হয়েছে এবং এ সমাজকে আরও রসাতলে নেয়ার জন্য যেন মোবাইল ফোন অপারেটররাও পাল্লা দিয়ে নেমেছে।

আমরা দাবি করি আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। আমাদের লেখাপড়ার হার বেড়েছে, আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। আমরা খতিয়ে কি দেখেছি যে, এই বাড়ার হার কতটুকু? কতজনের বেড়েছে? আমরা কথা-বার্তায় বা খোল নলচে বদলে যত দ্রুত নিজেদের আধুনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছি বা আধুনিক বলে দাবি করছি গোটা দেশের মানুষ কি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যেতে পারছে? আইনের দুর্বলতায় অপরাধ বাড়ে। আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ে চরিত্রের দুর্বলতা বাড়ে। কেউ যখন তার চারপাশে আলো ঝলমলে চাকচিক্য দেখে সে তখন তার নিজেকে ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সেওতো সমাজেরই অংশ। খারাপ জিনিসে প্রলুব্ধ হলে বা কেউ কোন কারণে নিজেকে বঞ্চিত ভাবলে তার মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়বেই। আর এতে সমাজের শান্তিও নষ্ট হয়। আর আমাদের সবার আসল লক্ষ্যই তো শান্তিপূর্ণ সমাজ, শান্তিপূর্ণ দিনযাপন। যত ভালই খান, ভোগ করেন- শান্তিই আসল।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



মন্তব্য চালু নেই