বঙ্গবন্ধুর জন্য সোবাহানের এক বছর রোজা!

পাক হানাদার বাহিনীর হাতে যাতে নির্মম মৃত্যু না হয়, আল্লাহ তায়ালা যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে বাঁচিয়ে রাখেন। এজন্য এক বঙ্গবন্ধু ভক্ত দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে মিনতি জানিয়ে নিয়ত করেছিলেন টানা এক বছর রোজা করার। সেই নিয়ত তিনি পূর্ণ করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে পাকহানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার খবর রেডিওতে শোনার পর আল্লাহর দরবারে ওই মিনতি জানিয়েছিলেন মুজিবভক্ত আব্দুস সোবাহান। নিয়ত করার পরের দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ তারিখ থেকে রোজা থাকা শুরু করে পুরো এক বছর পূর্ণ করেন তিনি। তবে ধর্মে নিষেধ থাকায় ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা করেননি।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিরল এ ভালোবাসার দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন আব্দুস সোবাহান। বর্তমানে তার বয়স ৮৫ বছরের মতো। এখনও তিনি প্রতি ওয়াক্তে দু’রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করেন এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করেন বঙ্গবন্ধুকে আল্লাহ তায়াল যেন জান্নাতবাসী করেন।

কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার অধীনে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন দক্ষিণ বড়বেড় দ্বীপ চরে আব্দুস সোবাহানের বাড়ি। ওই চরের আফাজ উদ্দিন ব্যাপারীর ছেলে আব্দুস সোবাহান। সংসার জীবনে তার দুই ছেলে ও ৬ মেয়ে। ছেলেদের বিয়ে করিয়েছেন এবং মেয়েদের বিয়েও দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুস সোবাহানের পারিবারিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। জমিজমা ও গোয়াল ভরা গরু ছিল। কিন্তু এখন তার কিছুই নেই। বারবার ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে জমাজমি ঘরবাড়ি সব কিছু হারিয়ে এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। তার দুই ছেলের একজন ট্রাক চালক আরেকজন ইটখোলায় কাজ করেন। এখন তার ওই দুই ছেলে বিয়ে করে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় বাড়ি করেছেন।

রাজীবপুর মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলহাজ আজিম উদ্দিনের কাছে ওই বিরল ভালোবাসার বিষয়টি জানার পর খোঁজা শুরু হয় আব্দুস সোবাহানকে। রাজীবপুর উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপচর বড়বেড় চরে যেতে সময় লাগল প্রায় তিন ঘণ্টা। মোটরসাইকেলে নৌকাঘাট, তারপর ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয় ওই চরে।
প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য ভালোবাসা, এক বছর রোজা করা এবং গরু জবাই করে মিলাদ মাহফিল করার বিষয়টি জানতে পারি নির্বাচনে ভোট চাইতে গিয়ে।’

রোববার (৯ মার্চ) বড়বেড় চরে গিয়ে আব্দুস সোবাহানের কাছে জানতে চাওয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার ব্যক্তিগত ঘটনাবলী। তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আমি কোনো নেহাপড়া জানি না। স্কুলেও যাই নাই কোনোদিন। যুদ্ধের আগে ১৯৬৯ এর নির্বাচনে আমার বয়স ৩০/৩২ অবো। আমি সব সময় রেডিও হুনচি (শুনতাম)। রেডিওত শেখ সাহেবের ভাষণ শুইনা আমি তারে ভালবাইসা ফেলাই। তার কথা হোনার (শোনার) হাতে হাতে (সঙ্গে) আমার গতর (শরীর) জারায়া (লোম খাড়া হয়ে) যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘২৬ মার্চ রেডিওতে শুনি শেখ সাহেবকে পাকিস্তানিরা ধইরা নিয়া গেছে। দেশে যুদ্ধ শুরু হইচে। এ খবর হোনার পর আমার শরীর যেন কেমন করতিছিল। পরে আমি বিছানায় শুইয়া আছিলাম। আবার হুনলাম শেখ সাহেবকে নাহি মাইরা ফেলছে পাকিস্তানিরা। নানা কথা হুইনা জোহরের নামাজ পরার সময় আল্লাহ কাছে দু’হাত তুইলা দোয়া করলাম ‘আল্লাহ তুমি শেখ সাহেবকে বাঁচায়া রাহো তার নিগা (জন্য) আমি পুরো এক বছর রোজা করমু। তহন ছিল চৈত্র মাস। তারিখটা আমার মনে নাই। পরের দিন থিকা আমি রোজা থাকা শুরু করলাম। এক নাগাড়ে পুরো এক বছর রোজা থাকছি। আবার চৈত্র মাস আইলে আমার এক বছর রোজা পূর্ণ হয়। তয় (তবে) মাঝে দুই ঈদেও দিন রোজা আছিলাম না।’

তিনি আরো বলেন, ‘যে দিন দেশ স্বাধীন হইলো ওইদিন আমার বাড়িতে মিলাদ মাহফিলের পড়াইছি। আমার পালের একটা গরু জবাই করে গ্রামের মাইনসেক দাওয়াত দিছিলাম। বেহেক (সবাইকে) কইছিলাম (বলছিলাম) শেখ সাহেব যেন সুস্থভাবে দেশে ফিরা আইসে এজন্য আপনার দোয়া কইরেন। আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন এবং সহিছালামতে শেখ সাহেব দেশে ফিরা আইসে। এ জন্য আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া। দেশ স্বাধীন হইছে শেখ সাহেবও দেশে ফিরা আইছে তারপরও আমি রোজা নষ্ট করিনি। কারণ আল্লাহ তায়ালার কাছে ওয়াদা করেছিলাম এক বছর রোজা করব। তাই আমি পুরো এক বছরই রোজা থাকছি নামাজ পড়েছি।’

সোবহান আরো বলেন, এই এক বছর রোজা করতে একটু সমস্যাও হয়েছিল। যেমন অনেকদিন শেষ রাইতে ভাত থাকতো না। তহন না খাইয়াই রোজা করছি। ১৫ তারিখ (আগস্ট) রাতে শেখ সাহেব ও তার পরিবারের বেবাগ (সবাইকে) মাইরা ফেলার খবর পাইয়া আমি দুইদিন বিছানা থেকে উঠতে পারি নাই। পুরো এক মাস অসুখে অছিলাম।’

আপনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ভয় পাই। তারপরও মুক্তিযোদ্ধাদের আমি অনেক সহযোগিতা করেছি। ভাত পাক কইরা তাগের খাওয়াইছি। আমার পুকুরের মাছ আছিল, মাছ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের দিছি।’

আব্দুস সোবাহান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘যে মানুষটা দেশের জন্য কত কিছুই না করছে। যাকে পাকবাহিনীরাই মারল না, আমার দেশের মানুষ তাকে মাইরা ফেলাইল।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এহন বয়স অইছে। কহন যানি মইরা যাই।’

ওই চরের বাসিন্দা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আবার কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিত করেছেন। এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে আব্দুস সোবাহান যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন।

চরনেওয়াজী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহীদুল্লাহ হক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রংপুর কালমাইকেল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য সোবাহান যে রোজা করেছে এটা আমি জানি। আমি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ওই সোবাহানের উদাহরণ দিয়ে থাকি। যেহেতু আমি আওয়ামী লীগ দল করি। দলের বিভিন্ন সভায় সোবাহানের বিষয়টা তুলে ধরি।’

ওই চরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরন্নবী হোসেন বলেন, ‘এই সোবাহান বঙ্গবন্ধুর জন্য পুরো এক বছর রোজা করেছে। বাড়ি থেকে রান্না করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিছে। আমরা তাকে ভাত খাইতে বললে সে ভাত খাইত না। কয় আমি রোজা আছি। এই চরে ৮টি মুক্তি বাহিনীদের ক্যাম্প ছিল। চরের পশ্চিমপাশেই গাইবান্ধার কামারজানি। ওই খানে পাকবাহিনীদের অবস্থান ছিল। আমরা চর থেকে যুদ্ধ করেছি।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যার খবর শুনে আব্দুস সোবাহান দুইদিন অসুস্থ ছিলেন। বিছানা থেকে উঠতে পারতো না। যুদ্ধের সময় দিনের বেলায় তাকে আমরা অনেক কিছু খাবার সামনে আইনা দিছি। তারপরও সে খায়নি। কথা গুলো বলছিলেন ওই চরের বাসিন্দা নুর হোসেন (৬৬), ওছিমুজ্জামান (৬৬), মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম (৭০), মমতাজুর রহমান (৭৫) ও সাবেক ইউপি মেম্বার নুরুল হক।



মন্তব্য চালু নেই