বঙ্গবন্ধু যেভাবে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটির মালিক হলেন

নবাব হোসেন মুন্না : বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটির মালিক কিভাবে হয়েছেন তার সঠিক ইতিহাস বাংলাদেশের জনগণের জানা উচিৎ। বিএনপি চেয়ারপরসন বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের ৬ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্চাদালতের রায় অনুযায়ী ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার পর বিএনপি নেতারা অনেক স্ববিরোধী কথাবার্তা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করার নানা ধরনের অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। এর মধ্যে বিএনপি অনাবশ্যকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমান্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, ‘মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান তো নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলেন, তিনি কি ভাবে বাড়িটি বানালেন।’ বিএনপির এ প্রথম সারির নেতার এ ধরনের বেসামাল উক্তির পর বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুব দলের শীর্ষ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল হুঙ্কার ছেড়ে বলেন, ‘ বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে জিয়া স্মৃতি যাদুঘর বানানো হবে।’ তাদের সে ক্ষমতা থাকলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুড়িয়ে দিতে পারলে দেবেন এ নিয়ে ওই অর্বাচিনদের কথার পাল্টা কথা বলে নেই।

তবে অনাবশ্যকভাবে যেহেতু বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়ীর মালিক কিভাবে হলেন প্রশ্ন তোলা হয়েছে সেহেতু বাংলার সাধারন মানুষদের বাড়ীটির সঠিক মালিকানা ইতিহাস জানা উচিত। বিভিন্ন সংবাদপত্রের তথ্য থেকে এই বাড়িটির জন্ম ও সৃষ্টি সম্পর্কে যতটুকু গেছে তা পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, বাড়ি-ঘর সংসারের কোন খবরা খবরই তিনি তেমন রাখতেন না। এ দিকটি সামলাতেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবই। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মাথাগোজার কোন ঠাঁই ছিল না। কয়েক দফায় সরকারের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সরকারী বাসভবনেই তিনি থাকতেন। ১৯৫৪ সাল বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মন্ত্রী হন। কিন্তু সে সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ কংগ্রেস, তফসিলি ফেডারেশন ও গণতন্ত্রী পার্টি সরকার গঠন করলে সে সরকারের চীপ মিনিস্টার নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান, আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন, সেই মন্ত্রী সভার বাণিজ্য, শ্রম, শিল্প ও দুনীর্তিদমনমন্ত্রী। তখন বঙ্গবন্ধুর পিএস ছিলেন নুরুজ্জামান। সেই সময় তিনি মন্ত্রী হিসাবে সপরিবারে থাকতেন আব্দুল গণি রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে। তখনই পিডব্লিউডি থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ব্যক্তিদের প্লট বরাদ্ধ দেয়া হচ্ছিল। একদিন বঙ্গবন্ধুর সে পিএস পিডব্লিওডি থেকে একটি আবেদন ফরম সংগ্রহ করে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের হাতে এনে তুলে দেন। ফরমটি যথাযথভাবে পূরণের পর দাখিল করেন। আবেদনের পর ১৯৫৭ সালের শুরুতে বেগম মুজিবের নামে ১ বিঘার একটি প্লট বরাদ্ধ দেয়া হয়। যার মূল্যধরা হয় ৬ হাজার টাকা। নিয়ম মোতাবেক ২ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর বাকি থাকে ৪ হাজার টাকা। বাকি ৪ হাজার টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করা হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধু টিবোর্ডের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সেগুন বাগিচায় একটি বাসা তাঁর নামে বরাদ্ধ দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারির করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে সেগুন বাগিচার বাড়িটি তিন দিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে বলা হয়। ১৯৫৮ সালের ১৫ অক্টোবর বাড়িটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। টি বোর্ড থেকে প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর জীপটি এবং বাড়ির কিস্তি পরিশোধের জন্য রাখা ২ হাজার টাকা ও বেশকিছু মালামাল রেখে দেয়া হয়। এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বেগম মুজিব তাঁর সন্তানদের নিয়ে এক অনিশ্চিত ও সমস্যাসঙ্কুল অবস্থার মধ্যে পড়েন। কেননা, তাদেরকে আর তখন কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা তদবীরের পর সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠের পাশে মাসিক ২ শত টাকায় ভাড়ায় একটি বাড়িতে ওঠেন। কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবের পরিবার যে এ বাড়িতে থাকে তা জানাজানি হয়ে গেল। বাড়ির মালিক বেগম মুজিবকে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার জন্য বললেন। এ বাড়ি ছেড়ে বাধ্য হয়ে তিনি সন্তান সন্ততিদের নিয়ে আবার এসে ওঠেন; সেগুনবাগিচার একটি বাসার দোতলায়। ১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্ত হয়ে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে কন্ট্রোলার অব এজন্সিস পদে চাকুরী নেন। তখনই বেগম মুজিব বুঝেছিলেন, যে কোনভাবেই হোক তাঁকে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পরই বেগম মুজিবের নামে বরাদ্ধ পাওয়া জায়গাটিতে বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় । ১৯৬০-৬১ সাল থেকেই ধার-কর্জ ও বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতা এবং হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

বঙ্গবন্ধুর এ বাড়িটির নির্মাণকাজ তদারকী করেছিলেন তৎকালীন পিডবি¬উডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও পরবর্তীকালে পূর্ত সচিব মাইনূল ইসলাম। এ বাড়ি নির্মাণের কাজে আর্থিক ভাবে ও নানাভাবে সহযোগিতা করেছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও দাপ্তরিক সহকর্মীরা । সব’চে বেশী সহযোগিতা করেছেন বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের নির্বাহী কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের নূরুল ইসলাম। এই নূরুল ইসলাম ‘ক্রস ওয়ার্ড’ লটারী খেলতেন। আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর একজন কর্মকর্তা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল তার আত্মীক পারিবারিক সম্পর্ক। সে অফিসে ক্রস ওয়ার্ড লটারী খেলা সবার জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। একদিন লটারীতে ব্যবহার করেছিলেন শেখ রেহানার নাম। সেইদিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। এই টাকা তিনি গচ্ছিত রাখেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। বাড়ির নির্মাণ কাজে টাকার সংকট দেখা দিলে নূরুল ইসলাম এই গচ্ছিত টাকা কাজে লাগানো জন্য অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধের প্রেক্ষিতে এ টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তীতে তা যথাযথ পরিশোধ ও করা হয়। নূরুল ইসলাম যেহেতু এখনো জীবিত আছেন, তিনিই এ ইতিহাসের বাড়ি নির্মাণের সাক্ষী। বাড়ি নির্মাণকালীন কেয়ার টেকার ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার আরজ আলী। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের ঝাউগাছটি এনে দিয়েছিলেন, বদরুন্নেছা আহমেদের স্বামী নুরুদ্দিন আহমেদ। বাড়ির জানালার গ্রীল সরবরাহ করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা রংপুরের মতিউর রহমান। কোনমতে বাড়িটি নির্মাণ কাজ শেষ করে পরিবার পরিজন নিয়ে বঙ্গবন্ধু এ বাড়িতে ওঠেন ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর। একতলা এ বাড়িটিতে তখন ছিল দুইটি বেডরুম। এক রুমে থাকতেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব। অন্য রুমে থাকতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তার পাশে ছিল আর একটি কক্ষ। সে কক্ষটি রান্নাঘর হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এই রান্নাঘরেরই এক পাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল একটি ছোট রুম এ রুমটিকে ড্রয়িং রুম হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এইরুমের আসবাব বলতে ছিল একসেট বেতের সোফা মাত্র।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে টেলিফোনটি প্রথম সংযোগ দেয়া হয় সেটির নম্বর ছিল ২৫৬১। টেলিফোনটি নিয়ে বেশ মজার গল্প আছে। আইয়ুবের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রায়ই এ টেলিফোনটিতে আড়িপাততো। তাই, শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চাইলে নিজের নাম গোপন করে ‘বালিওয়ালা’ বলে নিজের পরিচয় দিত। আর সিরাজুল আলম খান নিজের পরিচয় দিত ‘ইটাওয়ালা’ বলে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটি তখন তৈরী হচ্ছিল সেহেতু পাকি সামরিক জান্তাকেও এ পরিচয়টি বিশ্বাস করতে হয়েছিল। কেননা বাড়িটি যেহেতু তৈরী হচ্ছে ‘বালিওয়ালা’ বা ‘ইটাওয়ালা’তো পাওনা টাকার জন্য তাগাদা দিতে ফোন করতেই পারে। তাই তারা এই নামে ফোন এলে তেমন আমলে নিত না। একজন স্বল্প আয়ের মানুষ যে ভাবে তিলে তিলে নিজের জন্য একটি মাথা গাজার ঠাঁই তৈরী করে থাকে; তেমনি ভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ৩২ নম্বরের এ বাড়িটিকে তিলে তিলে গড়ে তোলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ বাড়িটি একটা সময়ে এসে হয়ে যায় বাঙালিদের আশা-আকাঙ্খা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার বাড়ি। ১৯৭১ একাত্তর সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে হয়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের বীজ রোপন করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণে প্রাণে।

কিন্তু ১৯৭৫ সালে জিয়া ও খুনি ফারুক রশিদদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে এ বাড়িটি আবার চলে যায় জিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে নির্বাসন থেকে ফিরে এলে এই বাড়িটি তিনি ফিরে পান। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যে শেখ হাসিনা সংবাদপত্রে একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের সে নিলাম বিজ্ঞপ্তির তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ছিল। শেখ হাসিনা কাল বিলম্ব না করে ছুটে যান হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের অফিসে। ১২ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধের পর বাড়িটির দখল শেখ হাসিনাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর পৈতৃক এ বাড়িটিকে নিজে বা তার পরিবারের অন্য কেউ ভোগ দখল না করে বাড়িটিকে দান করে দেন বঙ্গবন্ধু স্মতি জাদুঘর নির্মাণের জন্য। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এ বাড়িটির মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের উদ্বোধন করা হয়। এই হলো বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ির ইতিহাস। এটা এখন আর কোনো সাধারণ বাড়ি নয়, এটি এখন ইতিহাসের বাড়ি। বাঙালির সৌর্য-বীর্যের বাড়ি। কিন্তু বিএনপির কুচক্রিমহল এই ঐতিহাসিক বাড়িটিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর তৈরী করা হুমকী দিচ্ছে। তাদের এ হম্বিতম্বি বাংলাদেশের সাধারন জনগণই প্রতিরোধ করবে।

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক।



মন্তব্য চালু নেই