বন্ধ শিল্প কারখানা চালুর উদ্যোগে অর্থমন্ত্রীর ‘না’

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় যে উদ্যোগ নিয়েছে তার বিরোধীতা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে তার মতামত জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন।

জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগের দিন অর্থাৎ গত ২১ সেপ্টেম্বর শিল্পমন্ত্রীকে লেখা এক আধা সরকারি চিঠিতে অর্থমন্ত্রী শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক বন্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগের বিরোধীতা করেছেন বলে শিল্পমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।

অর্থমন্ত্রী মনে করেন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারি সহায়তায় চালু হয়েছে সেগুলোর একটিও লাভের মুখ দেখেনি। বরং দিনের পর দিন সরকারি সহায়তায় টিকে আছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। নতুন করে কোন বন্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হলে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে সহায়তা দেওয়া হবে না।

সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন বন্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু হচ্ছে এমন সংবাদ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী তার চিঠিতে লিখেছেন, খবরের কাগজে দেখলাম যে, বন্ধ সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান শিল্প মন্ত্রণালয় আবার চালু করতে চাচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে খুলনা নিউজপ্রিন্ট, খুলনা হার্ডবোর্ড, ঢাকা চামড়া, বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড সেনিটারি, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল, চট্টগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স এবং আর আর টেক্সটাইল।

অর্থমন্ত্রী চিঠিতে বলেছেন, সবগুলো প্রতিষ্ঠানই বহুদিন ধরে বন্ধ এবং এর অনুপস্থিতি কারো নজরে পড়ে না। ব্যক্তি মালিকানা খাত ইতোমধ্যে এইসব প্রতিষ্ঠানের স্থান দখল করে নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবহিত যে, চট্টগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স যেমন ক্লোরিন উৎপাদন করতো। এখন এই পণ্যের বাজারে যথেষ্ঠ উদ্বৃত্ত পণ্য দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। কাগজের বাজারে পুরো চাহিদাই বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানা খাতের মিলই মেটাচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এ অবস্থায় এইসব প্রতিষ্ঠান চালু করা শুধুই অর্থের অপচয় হবে। আমি আগে থেকেই সাবধান করে দিতে চাই যে, অর্থ মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগে কোন সহায়তা দিতে পারবো না। আমরা যে ক’টি বন্ধ মিল চালু করেছি সেগুলোর কোনটাই লাভের মুখ দেখে না এবং সরকারি সহায়তার উপর টিকে আছে।

সূত্র জানায়, এক সময় দেশে সাদা কাগজের মোট চাহিদার প্রায় সব মেটানো হতো এই নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের কাগজ দিয়ে। মিল এলাকার বেকার জনশক্তির উন্নয়ন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পদ্মা নদী থেকে সহজে পানি গ্রহণ ও নিষ্কাশন এবং নদী, রেল ও সড়ক পথে সহজে কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের সুবিধার কথা চিন্তা করে পদ্মা নদী থেকে এক কিলোমিটার দূরে শিল্পে অনগ্রসর উত্তরবঙ্গের পাকশীতে রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রীজের কাছে সরকারি মালিকানায় গড়ে উঠেছিল নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল (পাকশী পেপার মিল)।

তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (ইপিআইডিসি) ১৯৬৪ সালে এপ্রিল মাসে প্রকল্প পরিকল্পনা অনুমোদন করে। ১৯৬৫-৬৬ সালে ১৩৩ দশমিক ৭১ একর জমি অধিগ্রহণ শেষ হয় এবং ১৯৬৬ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ও দাতাদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং পরের বছর ৩ মার্চ মিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৭০ সালের জুনে। দেশের বিভিন্ন চিনিকল থেকে পাওয়া আখের ছোবড়ার উপরে ভিত্তি করেই মিলটি স্থাপিত হয়। আঁখের ছোবড়া পাকশী নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের মূল উপাদান। এছাড়া সিলেট পাল্প, বিদেশী পাল্প, পাটকাঠী, গমের নাড়া কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

সূত্র জানায়, চিনিকলগুলোতে চিনি উৎপাদনের জন্য আখ মাড়াইয়ের পর আখের ছোবড়া সড়ক ও রেলপথে মিলে আনা হতো। নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল কাগজ সভ্যতার ইতিহাসে অত্যাধুনিক মিল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এবং কাগজের মান উন্নত হওয়ায় কাগজ অবিক্রিত থাকার কোন সুযোগ ছিল না। তারপরও সম্ভাবনাময় এই মিলটিকে বাঁচানোর কোন উদ্যোগ না নিয়ে বরং সম্পূর্ণ খোড়া অজুহাতে তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী মিলটি ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর বন্ধ ঘোষণা করেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর বছর থেকেই লোকসান দিয়ে আসছিল। মিলটি উৎপাদন শুরু করার প্রথম ২৪ বছরে লোকসান দিয়েছে ১৯২ কোটি টাকা যা মিলটি বন্ধ হওয়ার আগের ১০ বছরে প্রায় ১০৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ কোটি টাকায় পৌঁছায়।

দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল। বিপুল লোকসানের কারণ দেখিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর মিলটি বন্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫৭ সালে খুলনার খালিশপুরে মিলটির যাত্রা শুরু। দিন দিন লোকসান বাড়ায় মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। মিলটি পুনরায় চালুর লক্ষ্যে গঠিত ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি সমীক্ষা চালিয়ে ২০০৯ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মিলটি আধুনিকায়ন করে সাদা কাগজ উৎপাদনের প্রস্তাব করে। কিন্তু এরপর এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরবর্তী সময়ে মিলটি চালুর উদ্দেশে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্যরা ছিলেন তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। বর্তমান মন্ত্রী পরিষদে এখন আর এদের কেউ নেই।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারিভাবে গঠিত একটি টেকনিক্যাল কমিটি বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ ও সম্ভাব্যতা যাচাই করে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। প্রতিবেদনটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোন আশ্বাস দেয়নি।

চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স (সিসিসি) পরিচালনা করছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। চট্টগ্রামের বাড়বকুন্ডে ৪০ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত সিসিসিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। প্রতিষ্ঠানটি বছরে সাত হাজার টন কস্টিক সোডা, সাত হাজার ২০০ টন হাইড্রোক্লোরিক এসিড, চার হাজার ৬০০ টন ক্লোরিন লিক্যুইড এবং ৬০০ টন ব্লিচিং পাউডার উৎপাদন করতে সক্ষম। লোকসানের কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০২ সালের ডিসেম্বরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।



মন্তব্য চালু নেই