বন কমছে, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বনভূমি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিবেশব্যবস্থা। পৃথিবীর প্রাণী, গাছপালা, পতঙ্গের প্রায় অর্ধেক প্রজাতির আশ্রয়স্থল এই বনভূমি। বনভূমি অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও বাতাসের আর্দ্রতার ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় যে পরিমাণ বনভূমি থাকা প্রয়োজন তা বাংলাদেশে নেই। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ কারণে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণও বাড়ছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মধ্যে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা সুন্দরবন ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলোই বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিদ্যমান প্রাকৃতিক বনের প্রায় ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশই ধ্বংসের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। একটি দেশে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় মোট ভূখণ্ডের প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে রয়েছে ১০ শতাংশের মতো। যদিও সরকারি কাগজে-কলমে ১৫ শতাংশের মতো রয়েছে। কিন্তু সঠিক তথ্য জানে না কেউ। কারণ দেশে কী পরিমাণ বনভূমি রয়েছে সঠিক ও হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই কোথাও। এর মধ্যে আবার বন বিভাগের বিপুল পরিমাণ বনভূমি রয়েছে বেদলখে।

এ পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশেও আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক বন দিবস’। ‘বন প্রকৃতির শক্তির আধার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় এখানেও উদযাপিত হচ্ছে দিবসটি।

পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে হলে বনভূমি সংরক্ষণে জোরালো উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে। বাস্তবায়ন করতে হবে ফরেস্ট্রি মাস্টারপ্ল্যান। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের আগ্রহহীনতা এবং সমন্বয়ের অভাবেরও অভিযোগ আছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশে বন আর কৃষিজমি দুটোই কমছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক ‘বিশ্বের বনাঞ্চল ও কৃষিজমি’ নিয়ে সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৫ বছরে দেশের ৬৫ হাজার হেক্টর বনভূমি কমেছে। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরেই কমেছে ১৩ হাজার হেক্টর। আর ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশের কৃষিজমি কমেছে ১১ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর।

বন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ১৯৯০ সালে দেশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ছিল ৪ লাখ ১ হাজার হেক্টর। ২০০০ সালে তা ৩ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর এবং ২০০৫ সালে ৩ লাখ ৯৫ হাজার হেক্টরে নেমে আসে। ২০১৫ সালে ম্যানগ্রোভ বনের আয়তন ৩ লাখ ৯০ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। প্রাকৃতিক এ বনজ ব্যবস্থা সংকোচনের ধারাবাহিকতা ২০১৬ সালেও দেখা গেছে।

শালবনের আয়তন ১৯৯০ সালে ২৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর থাকলেও ২০০০ সালে তা ২১ হাজার ৯৯০ হেক্টর এবং ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৯০ হেক্টরে নেমে আসে। একইভাবে পার্বত্য বন ১৯৯০ সালে ১ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর থাকলেও ২০১৫ সালে তা ৭৯ হাজার ১৬০ হেক্টরে নেমে আসে। ২৫ বছরে পার্বত্য বন কমেছে ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর।

মানবসৃষ্ট কারণের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সুন্দরবনসহ দেশের বনভূমির জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বসতি স্থানান্তর ও অন্যান্য কারণে মাটি ও পাহাড়ের ওপর চাপ বাড়ছে। অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি ও শীতকালে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ৩ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়বে ২ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, বন অধিদপ্তরে সুশাসন ও দক্ষতার অভাবের কারণে বনাঞ্চল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। বনাঞ্চল রক্ষায় গৃহীত কার্যক্রম জোরদার এবং সামাজিক বনায়নে মালিকানার বিষয়টি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বনাঞ্চল রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আইন, নীতিমালা, জনবল ও উপযুক্ত উপকরণের সমন্বয়ে বন অধিদপ্তরকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।

সাবেক এই প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) বলেন, ‘দেশে এখন সুন্দরবন ছাড়া আর কোনো প্রাকৃতিক বনাঞ্চল নেই বললেই চলে’।

বন অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশ ফরেস্ট্রি মাস্টারপ্ল্যান ২০১৭-২০৩৬’ শীর্ষক খসড়ায় উঠে এসেছে, বিগত ২৫ বছরে দেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমেছে। বনাঞ্চল রক্ষায় নেই সমন্বিত উদ্যোগ। বিদ্যমান প্রাকৃতিক বনের প্রায় ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশই ধ্বংসের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।

মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মধ্যে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা সুন্দরবন ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলোই বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশে বনজ সম্পদের বর্তমান অবস্থা, বিরাজমান ঝুঁকির পাশাপাশি বন অধিদপ্তরের মহাপরিকল্পনায় বনভূমি ধ্বংসের তুলনামূলক তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে সুন্দরবন কমেছে ১০ হাজার ৯৮০ হেক্টর। একই সময়ে শালবন ৬ হাজার ১৬০ হেক্টর এবং পার্বত্য বনাঞ্চল ৪৮ হাজার ৮১০ হেক্টর কমেছে। একইভাবে বাঁশবাগান কমেছে ৭৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর।

খসড়া মহাপরিকল্পনায় বন অধিদপ্তর বলেছে, দেশে যে বনাঞ্চল রয়েছে, সেগুলোও ধ্বংসের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যমান বনাঞ্চল রক্ষা করা ছাড়াও ৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজন রয়েছে বলে মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জনবল সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের অনুপস্থিতি বনভূমি রক্ষায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি বন বিভাগের অদক্ষতা, জনসচেতনতার অভাব এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞার কারণে দেশের বনাঞ্চল ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

দেশে বনাঞ্চল কমার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনও ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক দশকে ঝড়, বন্যা ও অতিবর্ষণের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে যে ভাঙন হয়েছে, দেশের বনাঞ্চলে তার নানামুখী প্রভাব পড়েছে। জীবিকা, আবাসনসহ নানা প্রয়োজনে বনভূমিতে মানুষের নির্ভরতা ও চাপ বাড়ছে। বনাঞ্চল হ্রাসের এ ধারা ঠেকানোর পাশাপাশি নতুন বন সৃজন করতে না পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়বে দেশ। বাড়বে উষ্ণতা, পরিবর্তিত হবে ঋতুচক্র, বিঘ্নিত হবে বাস্তুব্যবস্থার ছন্দ। ফলে সরাসরি প্রভাব পড়বে শস্য আবাদ ও জনজীবনে। এতে বিঘ্নিত হবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা।

প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার (আইইউসিএন) হিসাবে পৃথিবীতে যে পরিমাণে কার্বন নিঃসরিত হয়, তার অর্ধেকের বেশি গাছ শুষে নেয়। বিশ্বের বৃষ্টি ও নদী দিয়ে আসা মিষ্টি পানির ৭০ শতাংশই গাছ ধরে রাখে। পৃথিবীর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ এখনো বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশেও এর কাছাকাছি চিত্র দেখা যায়।

বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী বলেন, বন সংরক্ষণে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সরকারীভাবে সারাদেশে ২০০ অভিযান পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতায় তার চেয়ে বেশি হচ্ছে। তারপরও বনের ওপর আগ্রাসন থেমে নেই। তবে আমরা আশা করছি, এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি- ২০২০ সাল নাগাদ দেশে ২০ শতাংশ বন নিশ্চিত করার।



মন্তব্য চালু নেই