বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও আমরা

আমরা জাতি হিসেবে বিলম্বিত ভাগ্যের অধিকারী। পলাশীর প্রান্তরে হারানো স্বাধীনতা উপমহাদেশে প্রায় ১৯০ বছর পর ফিরে এলেও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৩টি বছর। এর চেয়েও পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীন দেশে একটি শিক্ষানীতি পেতে পেরিয়ে গেছে ৩৯টি বছর। এত চাওয়ার পর পাওয়া শিক্ষানীতি আমাদের কী স্বপ্ন দেখাতে পারলো আর কী পারলো না সে হিসেব মেলাতে মন নহে মোর রাজি।

আমরা সাইকেল চালানো শিখি মাঠে। তার অর্থ এই নয় যে, সাইকেল সবসময় মাঠেই চালাতে হবে। মূলত রাস্তায় সাইকেল চালানোর প্রস্তুতি আমরা নেই মাঠে। একইভাবে আমাদের পাঠ্যবই জীবনের প্রস্তুতির জন্য, শুধু পাঠ্যবই নিযে ব্যস্ত থাকার জন্য নয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে প্রশ্ন করা হলে সংশ্লিষ্ট সবাই একবাক্যে বলে ওঠেন যে- বইয়ের বাইরে থেকে প্রশ্ন এসেছে। অর্থাৎ সবাই ধরে নিয়েছে- বই থেকে হুবহু প্রশ্ন আসতে হবে। হ্যাঁ, ছাত্রছাত্রীদের বয়স অনুযায়ী প্রশ্ন হতে হবে, তা সে যে বিষয়েরই হোক। এই বিষয়টিও শিক্ষক তথা প্রশ্নপ্রণেতাদের ভালোভাবে জানতে হবে। ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়গুলো বরাবরই কঠিন বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞান পড়ার ভয়ে অনেকেই এখন বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দিয়েছে। এখন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী পাওয়া দুষ্কর, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। গণিতে ফিগার পরিবর্তন করে দিলে শিক্ষার্থীরা তখন আর গণিত পারে না; অর্থাৎ তাদের ভিত্তিটা ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। আর ইংরেজির ক্ষেত্রে পাশের হার বেড়েছে পাল্লা দিয়ে, কিন্তু বাস্তব জীবনে ইংরেজি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দৈন্যতা পূর্বের চেয়েও প্রকট। ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষ নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচেছ। দেশব্যাপী ওয়ার্কশপ করছে কিন্তু অবস্থার কতোটা পরিবর্তন হবে জানি না। কারণ শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, প্রশ্নপ্রণেতা, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং রাজনীতিকরণ ইংরেজিতে পাশ করা এবং ইংরেজি জানার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

কোন জাতির শিক্ষার বাহক হলো শিক্ষক। শিক্ষকদের যদি সঠিকভাবে গঠন করা যায় তাহলে জাতির শিক্ষার বিস্তার হবে পৃথিবীর অন্যান্য জাতির শিক্ষার বিস্তারের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশের চেয়ে সর্ব নিম্ন বেতন দেয়া হয় এবং ভাল কোন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তার দক্ষতা উন্নয়নের কোন রকম চিন্তা করা হয়না। সরকারকে দেশের শিক্ষক সমাজের উন্নততর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে তাদের দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাকে আরো দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ অতি জরুরী।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যতগুলো সমস্যা থাকার কথা তার সবগুলোই এখানে আছে। তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ যত বেশি তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের পকেট ভারী করার সুযোগও তত বেশি। এই প্রজেক্ট, সেই প্রজেক্ট-প্রজেক্টের কোন অভাব নেই। যত্রতত্র এনজিও’রও অভাব নেই। বিদেশি ডোনারদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানোই এদের কাজ। যখন রাষ্ট্র তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যে ব্যর্থ হয় তখন বিদেশি দাতা গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধনী রাষ্ট্রগুলো কিছু ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে তার দ্বিতীয় ফেজ শুরু হয়েছে। দেশি বুদ্ধিজীবিরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা আর সাদা চামড়া ও চকচকে কালো চামড়ার বিদেশি বিশেষজ্ঞরা নিয়েছে মোটা অংকের ডলার। কিছু গ্রামীণ বিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে, পাঠ্যক্রমে বিদেশি পাঠ্যপুস্তকের জটিল অনুবাদ কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এতে পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতায় অসামঞ্জস্যতা প্রকট হয়েছে। আর যেটা হয়েছে সেটা হল বছরে বছরে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন। প্রচুর শিক্ষার্থী হয়েছে গিনিপিগ। শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক গুণগত পরিবর্তন খুব সামান্যই হয়েছে। এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ, বিদেশ গমন, শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ না করা আমলা কর্তৃক শিক্ষাক্রম প্রস্তুতকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে গণহারে শিক্ষাবিদ উপাধি দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করানো। শিক্ষাবিজ্ঞান এখন এত বড় একটি ক্ষেত্র যে এটি নিয়ে দীর্ঘ সময়ে কাজ না করলে এবং তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক পর্যায়ে যথাক্রমে পড়াশোনা ও কাজ না করলে কোন স্থায়ী, গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি উপহার দেওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, প্রচলিত শিক্ষাক্রমেই অনেক উন্নতমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত যদি মেধাবী ও উন্নত মানসিকতার তরুণরা গণহারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিত। আইন যেমনই হোক না কেন যোগ্য ও সৎ বিচারপতি ঠিকই ন্যায়বিচার উপহার দিতে পারেন। ঠিক তেমনি শুধুমাত্র সমাজের উচ্চ মেধাস্তরের ছেলেমেয়েদের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত করা গেলেই বর্তমান শিক্ষা সমস্যার সিংহভাগ সমাধান হয়ে যেত।

তথ্যপ্রযুক্তি,জ্ঞান–বিজ্ঞানে বিশ্ব তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা চলছে এক দেশের সাথে আরেক দেশের। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অবস্থান কোথায়? কেউ যদি বলেন আমরা তো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ারই যোগ্যতা অর্জন করতে পারলাম না। তাহলে খুব একটা ভুল হবে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি?

নিশ্চিতভাবেই উন্নতমানের শিক্ষা ও তার প্রয়োগের মধ্য দিয়েই আমরা শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নয়, একটি স্বনির্ভর জাতিতে পরিণত হবো। কিন্তু আমাদের কি দুর্ভাগ্য, উন্নতমানের শিক্ষা তো দূরে থাক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই ভঙ্গুর। পুরো চিত্রই যে হতাশাজনক তা নয়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান চিত্র দেখে আশাবাদি হওয়াটাও কঠিন। এ শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া এটি প্রকৃত শিক্ষাদান ও জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারবে না। শুরুতে যেটি দরকার তা হচ্ছে এর গলদগুলো খুঁজে বের করা। তারপরই সম্ভব সঠিক সমাধানে পৌঁছা।

ভাগ্যবিলম্বিত এই জাতির জীবনেও ক্ষণিকের সৌভাগ্য এসেছিল বেশ কয়েক বার। কখনো একুশের রক্তাক্ত দুপুরে, কখনো একাত্তরের নয় মাস। তাই এখনো আশায় বুক বাঁধি, বাংলাদেশ সব সমস্যা থেকে মুক্তি নিয়ে একদিন ঠিকই বুক ফুলিয়ে বিশ্ব কাঁপাবে।

লেখক :
সাফাত জামিল শুভ
শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



মন্তব্য চালু নেই