‘বাংলাদেশি আইএস জিহাদিরা দেশে ফিরতে শুরু করেছে’

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি রোববার ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দি এশিয়ান এজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গত ১লা জুলাইয়ে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর হামলায় আন্তর্জাতিক যোগসূত্র আছে বলে মন্তব্য করেছেন।

তিনি আরো বলেন, বিরাট চাপে থাকার কারণে আইএস রমজান মাসে হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়ে আসছিল। আর হামলাকারীদের একসঙ্গে নিখোঁজ হওয়া ও একত্রে হামলায় অংশ নেয়া এবং আইএস কর্তৃক তাদের ইমেজ আপলোড করার ঘটনার সবটাই আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের ইঙ্গিত দেয়।

বর্তমানে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত বীণা সিক্রি এই সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেন, এসব দেশের অভ্যন্তরেই বেড়ে উঠছে, তখন তিনি ঠিকই বলেন। কিন্তু একইসঙ্গে এর যে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র আছে সেটাও সত্য। ২০১৪ সালে আইএস বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ড জয় করলেও আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের হস্তক্ষেপের মুখে তারা সেই ভূখণ্ড হারাতে শুরু করেছে।

তার কথায়, ‘বেশ কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি জেহাদি আইএসের হয়ে যুদ্ধ করছে এবং তারা ব্যাপক সংখ্যায় দেশে ফিরতে শুরু করেছে।’ এছাড়াও আইসিসের মতো বৈশ্বিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। কাজেই তাদের প্রচেষ্টা শুধু সরকার উৎখাত করা নয়- আরো বড় কিছু। অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকার রাজপথে ইতালীয় ত্রাণকর্মী সিজার তাভেলাকে হত্যার দায় স্বীকার করে প্রথম বিবৃতি দিয়েছিল আইএস এবং সর্বশেষ গত ১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় মার্কিনসহ ২০ জন বিদেশিকে হত্যার পরেও তারা দায়িত্ব স্বীকার করে। কিন্তু বাংলাদেশ আইএসের দাবি মানতে রাজি নয়। সর্বশেষ আইজিপি বলেছেন, গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় জেএমবি জড়িত।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ওই সাক্ষাৎকারে আরো বলেছেন, বাংলাদেশ বাঙালি ও তার মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে আটকে গেছে।

দেশটি জন্ম নিল জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রের ভাবধারার মধ্যে আর এখন সেখানে রেডিক্যাল ইসলাম মাথাচাড়া দিচ্ছে, ভুলটা কোথায়? সঞ্জিব বড়ুয়ার এই প্রশ্নের জবাবে বীণা সিক্রি বলেন, এর তিনটি দিক আছে। বাংলাদেশি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ডাইমেনশন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি বুঝতে হলে এগুলোকে আলাদাভাবে বুঝতে হবে। শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া একত্রে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু ২০০০ সাল থেকে দেখা গেল ধীরে ধীরে ইসলামী শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব পেয়েছে।

গত দুবছর ধরে বাংলাদেশি তরুণদের রেডিকালাইজেশনের পথে যেতে দেখা গেছে। এটা খুবই একটা বড় ঘটনা। আর সবশেষ ঢাকা হামলায় (আর্টিজান রেস্তরাঁ হামলা) দেখা গেল একদল তরুণ একসঙ্গে নিখোঁজ হলো, তারা একসঙ্গে উদয় হলো। আইএস তাদের ইমেজ আপলোড করল। এর সবটাই একটি আন্তর্জাতিক লিংক থাকার ইঙ্গিত দেয়।
প্রশ্ন: এই হামলা বাংলাদেশ সমাজের নানা ভাঙাচোরা পরিষ্কার করল। এটা কি স্বাধীনতার গোড়ার সময় থেকেই বজায় ছিল?

বীণা সিক্রি: বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী পরিচিতি সব সময়ই শক্তিশালী। বাঙালি ও মুসলিম পরিচিতির মধ্যে সব সময় একটা লড়াই চলছে। এতদিন এর মধ্যে একটা ভারসাম্য ছিল। কিন্তু এখন যেটা ঘটছে সেটা হলো জামায়াত তাদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্র ঝালাই করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য ফায়দা তুলতে চাইছে। যদিও দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ভালোই উন্নতি করছে। কিন্তু এসব স্বার্থের কারণে দেশটির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, বিশৃঙ্খলার দিকে যাচ্ছে, সুতরাং ঢাকা হামলা একটি বড় ওয়েকআপ কল।

সাম্প্রতিককালে আমরা শাহবাগ আন্দোলনের মতো বড় ধরনের জনপ্রিয় আন্দোলন দেখেছি। এরপর শুরু হলো ব্লগার, ভিক্ষু ও পুরোহিতদের ওপর হামলা এবং তা খুবই নৃশংস উপায়ে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আর সেটা হলো পাকিস্তানি এস্টাব্লিশমেন্টে বিশেষ করে তাদের সিক্রেট এজেন্সিগুলোর সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক, যা একাত্তরের পরেও বন্ধ হয়নি বরং তা আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে

প্রশ্ন: কেন উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের তরুণরা সালাফি মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল?
বীণা সিক্রি: বাংলাদেশি সমাজ আড়ষ্ট ও স্তম্ভিত হয়ে গেছে। তারা কখনও ভাবতে পারেনি যে, এটা ঘটে যাওয়া সম্ভব। হামলাকারীরা যাদের সন্তান, তাদের সবাই চেনেন। এমনও নয় যে, তারা মাদরাসাপড়ুয়া। বাড়িতে সব ধরনের আরাম-আয়েশ পেয়ে বড় হয়েছে তারা। আইসিস এখন বিরাট চাপে আছে, তাই তারা সন্ত্রাসী হামলা চালানোর সময় হিসেবে রমজানকে বেছে নিয়েছে।

প্রশ্ন: এটা কি ঠিক নয় যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনও অস্বীকার করার মনোভাব নিয়েই আছে। এটা কতদূর সত্য এবং কেন?
বীণা সিক্রি: শেখ হাসিনা যখন বলেন, এসব দেশের অভ্যন্তরেই বেড়ে উঠছে তখন তিনি ঠিকই বলেন কিন্তু একইসঙ্গে এর যে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র অছে সেটাও সত্য। সন্ত্রাসীদের অধিকাংশই স্থানীয়। ২০১৪ সালে আইসিস যখন গঠিত হলো, তখন তারা বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ড জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এরপরে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের হস্তক্ষেপের মুখে তারা সেই ভূখণ্ড হারাতে শুরু করলো। এখন বেশকিছু সংখ্যক বাংলাদেশি জেহাদি আইসিসের হয়ে যুদ্ধ করছে এবং তারা ব্যাপক সংখ্যায় দেশে ফিরতে শুরু করেছে।

প্রশ্ন: এটা বলা হয়ে থাকে যে, ২০১৪ সালের নির্বাচন, যা ইসলামীরা বয়কট করেছিল, সেই নির্বাচনের পরে বাংলাদেশে ইসলামী রেডিক্যালিজম সীমাহীনভাবে বেড়েছে। আপনি কিভাবে দেখেন?
বীণা সিক্রি: ২০১৪ সালের নির্বাচন যখন জামায়াত ও বিএনপি বয়কট করে নির্বাচন ঠেকানোর সিদ্ধান্ত নিলো, সেই থেকে তারা যে বাস্তব সহিংসতা শুরু করেছিল তার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। বর্তমানে যে সহিংস পরিবেশের সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে সেটা তারই ভগ্নাংশ।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে যে রেডিক্যালিজম বাড়ছে সেটা ভারতের জন্য কি তাৎপর্য বহন করে? বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের জন্য তার গুরুত্ব কি?
বীণা সিক্রি: সংবেদনশীলতা ও গুরুত্ব ভারতের বিশেষ করে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য অবিশ্বাস্যভাবে অসামান্য। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা যখন ইসলামীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলেন এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিলো না, তখন তার প্রভাব গোটা ভারতের ওপর এসে পড়লো। এমন সব লোকের উদ্ভব ঘটলো, যারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকলো এবং সেখানে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করলো এবং অবৈধভাবে গাঁজা চাষ শুরু করলো। দেখুন কালুচকে কি ঘটলো, যেখানে একটি পুলিশ স্টেশন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলো। সেটা যদিও ওভাবে প্রচার পেলো না কিন্তু সেটা তো একটা মারাত্মক ঘটনা।

প্রশ্ন: এর প্রতি বাংলাদেশি উদারনৈতিক সমাজের নীরবতা কি মনে হয় না বিস্ময়কর?
বীণা সিক্রি: সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই। এমনকি শেখ হাসিনা বলেছেন, ঢাকার রেস্তরাঁয় যারা হামলা করেছে তারা মুসলিম নয়। বাংলাদেশের উদারপন্থিদের সরব হতে হবে, তবে এ পর্যন্ত তারা নীরবতাই পালন করে যাচ্ছেন। -এমজমিন



মন্তব্য চালু নেই