বাংলাদেশে নারীরা সাংবাদিকতায় কতটা এগিয়েছে?

বাংলাদেশে প্রায় সাত দশক আগে নারীদের জন্য গড়ে তোলা বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম প্রয়াত হয়েছেন এই সপ্তাহেই। সাত দশক পর এসে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে এখন অনেক নারী সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন।

বিশেষ করে দেশটির ক্রমবর্ধমান টেলিভিশন শিল্পে নারীদের উপস্থিতি পুরুষদের চাইতে কোন অংশে কম নয়।

কিন্তু মূলধারার সংবাদপত্রগুলোতে নারীরা বলতে গেলে ব্রাত্য হয়েই রয়েছেন। আর সাংবাদিকতার কোন প্লাটফর্মেই নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের অত্যন্ত ব্যস্ত একজন সাংবাদিক লাখমিনা জেসমিন সোমা। তিনি রাজশাহীতে ছাত্রী থাকাকালীনই শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতার কাজ।

গত দেড় বছর ধরে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন একজন পূর্ণকালীন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে।

তিনি সাধারণত রাজনীতি বিষয়ক রিপোর্ট করেন। গত দেড় বছরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে তার অসংখ্য প্রতিবেদন। তার স্বপ্ন নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলা। বাংলাদেশ প্রতিদিন নামের একটি জাতীয় দৈনিকে তিনিই একমাত্র নারী প্রতিবেদক।

কাজ করার হরেক চ্যালেঞ্জ:

রোজিনা ইসলাম বাংলাদেশের জনপ্রিয় পত্রিকা প্রথম আলোর সিনিয়র সংবাদদাতা। তিনিও একজন ব্যস্ত রিপোর্টার।

পত্রিকাটিতে তার করা বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান যারা রেখেছেন তাদেরকে সরকারের দেয়া একটি সোনার ক্রেস্ট তৈরি করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বড় ধরণের অনিয়ম ফাঁস করে মিসেস ইসলাম বাংলাদেশে বিপুল আলোচনার সূত্রপাত ঘটান।

এই প্রতিবেদনটির কারণে তিনি আন্তর্জাতিকভাবেও পুরস্কৃত হয়েছেন।

তিনি মূলত সচিবালয় বিটের সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অফিসে এবং সচিবালয়ে তাকে বিস্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলতে হয় বলে তার ভাষ্য।

কিন্তু যুদ্ধ করেও সাংবাদিকতায় টিকে থাকতে পারেননি তাসলিমা মিজি।

“কাজ করতে গিয়ে নারী হিসেবে আমার অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জগুলো এত বেশী ছিল যে শেষ পর্যন্ত আমি সাংবাদিকতায় টিকতেই পারিনি”, বলছিলেন তাসলিমা মিজি।

বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে যেসব নারীরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠের সাংবাদিকতা করতে চান, তাদের মধ্যে তাসলিমা মিজির মতো ব্যর্থতার গল্প রয়েছে ঘরে ঘরে, রোজিনা ইসলামের মতো সফলতার গল্প হাতে গোনা।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে নারীরা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলছেন, “সাংবাদিকতাটাকে নারীর পেশা বলে মনে করা হয় না, এরকম মনোভাব আমি অনেক পুরুষ সাংবাদিকের মধ্যেই দেখেছি”।

গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্ট নামক এক বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণের বরাত দিয়ে ড. নাসরীন আরো বলছেন, গত দশ বছরে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়েনি, বরঞ্চ কোন কোন ক্ষেত্রে কমে গেছে।

নেতৃত্বে নারীরা নেই:

বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পিআইডি গাইড নামক যে টেলিফোন নির্দেশিকাটি প্রকাশ করা হয়, তার সর্বশেষ সংস্করণে উল্লেখিত প্রায় দুশোটি ইংরেজি, বাংলা ও অনলাইন পত্রিকার মধ্যে নারী সম্পাদক রয়েছেন মোট ছজন।

এদের সবাই সম্পাদক হয়েছেন মালিকানা সূত্রে, সাংবাদিকতা করবার সূত্রে নয়।

নারীরা প্রধান প্রতিবেদক ও বার্তা সম্পাদক পদে কাজ করছেন হাতে গোনা যে কটি পত্রিকায় তার সবগুলোই নাম সর্বস্ব।

আর তালিকাভুক্ত ২৫টি টেলিভিশনের মধ্যে নারী সিইও রয়েছেন একটিতে, নারী বার্তা প্রধান রয়েছেন একটিতে।

বেসরকারি টেলিভিশনের গত দেড় যুগের ইতিহাসে নারীদের প্রাধান্য দেখা গেছে মূলত সংবাদ উপস্থাপনায়, সাংবাদিকতা করতে করতে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় পদে আসীন হতে দেখা গেছে মুন্নী সাহার মতো হাতে গোনা দুএকজনকে।

সিনিয়র সাংবাদিক ও ইংরেজি দৈনিক নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বাংলাদেশে সংবাদ কক্ষের নেতৃত্বে নারীদের এগিয়ে আসার মত পরিবেশ তৈরি হয়নি।

“একজন নিউজ এডিটর যদি মহিলা হন, তাকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে, আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা এখনো মেয়েদের স্বপক্ষে নয়”।

“মেয়েদের মধ্যে যোগ্যতার অভাব আছে এটা আমি বলব না, কিন্তু পরিবেশের কারণে তারা এগিয়ে আসতে পারছে না। দায়িত্ব তারা নেয়ও না, মালিক তাকে দায়িত্ব দিতেও চায় না”।-বিবিসি বাংলা



মন্তব্য চালু নেই