বাঙালী নারীকে বাঁচাতে এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন ত্যাগ

আর একটু এগোলেই এভারেস্ট জয় করা অভিযাত্রীদের একজন হতেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী লেসলি জন বিনস। স্যার এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের পর যারা এভারেস্টে চূড়ায় উঠেছেন, সেই পাঁচ হাজারেরও কম অভিযাত্রীদের তালিকায় যোগ হতো তার নাম।

কারণ তিনি ছিলেন চূড়ার থেকে মাত্র হাত ছোঁয়া দূরত্বে। কিন্তু তা না করে, একজন বাঙালী নারীকে বাঁচাতে সেই হিমালয় জয়ের স্বপ্ন তিনি বিসর্জন দিয়েছেন।

তবে তাই বলে ব্যর্থ অভিযাত্রীদের মতো হারিয়ে যাওয়াদের দলে নয়, অভিনন্দনের স্রোতে এখন তিনি ভাসছেন। অভিনন্দন জানানোর তালিকা থেকে পর্বতারোহী বা সাধারণ মানুষ কেউই বাদ নেই। হিমালয় জয় না করলেও, অনেকের চোখেই তিনি এখন হিরো।এ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস।

পত্রিকাটি লিখেছে, বিপদে পড়ার একটু আগেই ভারতের এক সন্তানের মা সুনীতি হাজরা এভারেস্ট জয় করে নেমে আসছিলেন।কিন্তু অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং এভারেস্টের চূড়া থেকে নেমে আসার পথে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন। সেই সময় তার সাহায্যে এগিয়ে যান লেসলি জন বিনস।

ফেসবুকে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তার বন্ধু মার্কিন মেরিন মাইকেল ফেয়ারম্যান। তিনি লিখেছেন, চূড়ায় নীচের একটি অংশে একজন ভারতীয় তরুণী পিছলে লেসলির কাছাকাছি পড়ে যান। তখন ওই তরুণী ছিলেন অত্যন্ত ক্লান্ত আর পড়ে গিয়ে ব্যথাও পেয়েছিলেন। তার কাছে অতিরিক্ত অক্সিজেনও ছিল না। কোন দ্বিধা না করেই লেসলি তার সাহায্যে এগিয়ে যান।

লেসলি নিজের অক্সিজেন সিলিন্ডার সুনীতির সঙ্গে বদল করেন এবং তাকে উঠে দাড়াতে সাহায্য করেন। এ সময় আরো অনেকেই তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু কেউই সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি একাই সুনীতিকে আঁকড়ে ধরে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসেন।

আসার পথে নিজের টিমের আরো একজনকে দুর্দশার মধ্যে দেখতে পান লেসলি। তিনি ছিলেন তখন অনেকটা বিধ্বস্ত। কিন্তু তাকে চিৎকার করে, উৎসাহ দিয়ে হাটতে বাধ্য করেন লেসলি। কিন্তু তারপরেও তিনি হাটতে পারছিলেন না। তখন তাকেও ধরে, টেনে নামিয়ে আনতে শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি দুজন অভিযাত্রীকে নিয়ে এভারেস্টের সেই তুষারের ভেতর দিয়ে নিচে নামিয়ে আনেন।

তবে একপর্যায়ে সেই ব্যক্তিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন লেসলি। কারণ দুইজনকে টেনে নিয়ে আসার মতো শক্তি তার ছিল না। পরে অন্যরা তাকে উদ্ধার করে।

তবে সুনীতা হাজরাকে লেসলি নিজের তাবুতে নিয়ে আসেন। থার্মোফ্লাস্কের সুপ দিয়ে তাকে গরম হয়ে উঠতে সাহায্য করেন।

সেই সময়ে নিজের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মি. বিনস পরে কাঠমান্ডুতে একটি টেলিভিশন স্টেশনের কাছে প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন এভাবে, ”অবশ্যই আমার কিছুটা খারাপ লাগছে কারণ আমি চূড়া জয় করতে পারলাম না। কিন্তু আমি খুশী যে, আমি একটা জীবন বাঁচাতে পেরেছি।”

জীবন বাঁচানোর জন্য বিনসের কাছে কৃতজ্ঞ সুনীতি হাজরা। তিনি বলছেন, ”আমার জীবন তার কাছে ঋণী হয়ে রইল। আমি আমার সন্তানকে দেখতে বাড়ি ফিরতে পেরেছি। আর কি আমি বলতে পারি?” একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন।তিনি এভারেস্ট জয় করা প্রথম বাঙালী নারী, যার সন্তান রয়েছে।

মি.ফেয়ারম্যান তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ”এভারেস্টের এই পথে সেদিন অনেকেই মারা গেছেন। এই দুজনের ভাগ্যে কি ঘটতো তা আমরা জানি না। হয়তো তাদের কিছু হলে কেউই কিছু জানতেও পারতো না। শুধুমাত্র লেসলির নায়কসুলভ আচরণেই তা ঘটেনি।”

যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ার থেকে আসা লেসলি জন বিনস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে বসনিয়া, ইরাক আর আফগানিস্তানে কাজ করেছেন। সেখানে কাজ করার সময় বোমা বিস্ফোরণে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

যে টিমের সঙ্গে তিনি হিমালয়ে উঠেছিলেন, তার অপর সঙ্গীরা অবশ্য হিমালয় জয় করেই ফিরে এসেছে।



মন্তব্য চালু নেই