বাচ্চাদের শয়তানি! নাগিনদের ফোঁস ফোঁস, টেলিভিশনে কী ভীষণ কাণ্ড!

আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ভারতীয় টেলিভিশন ছিল আম-আদমির গল্প বলার মাধ্যম। কনটেন্ট, অভিনয়, পরিচালনা, সব দিক থেকেই সেই সময়টাকে ছোট পরদার ‘গোল্ডেন এজ’ ধরা হতো। কিন্তু নতুন শতাব্দীর শুরুতেই সবকিছু কেমন পাল্টে গেল। রোজকার চরিত্রেরা হাপিশ হয়ে গিয়ে চলে এল ঝলমলে পোশাক পরা কিছু চরিত্র। যারা রাতে শুতে গেলেও মুখে ফুল মেকআপ করে থাকে।

আম-আদমির রোজনামচা হারিয়ে গিয়ে ধারাবাহিকগুলো শুধু কোটিপতিদেরই গল্প বলতে শুরু করল। ধূসর চরিত্র হারিয়ে গিয়ে চলে এল ‘আদর্শ’ চরিত্র কিংবা সুপারভিলেন। গত দু’বছরে অবশ্য টেলিভিশন আরও পাল্টে গিয়েছে। কিম্ভূত ট্রেন্ডগুলো ধরার চেষ্টা করল ‘ওবেলা’।

মেগা সিরিয়ালের ব্যস্ত শিডিউলে বাচ্চাদের অভিনয় করানো কতটা ঠিক, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। কিন্তু মুখ্যচরিত্রে বাচ্চারা অভিনয় করলে যে টিআরপি বাড়তে বাধ্য, তা ভালই বুঝে গিয়েছেন নির্মাতারা। ‘ভুতু’ বা ‘পটলকুমার গানওয়ালা’র জনপ্রিয়তাই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। ফুটফুটে মিষ্টি বাচ্চারা পরদায় এলে, দর্শকের মন গলতে বাধ্য। কিন্তু সেই বাচ্চাদেরই যখন খলচরিত্রে কাস্ট করা হয় (‘পটলকুমার…’এ যেমন), তখন নৈতিকতার প্রশ্ন উঠবেই। টিভিতে বাচ্চাদের দেখালে বাড়ির বড়দের সঙ্গে পরিবারের ছোটরাও এই শো’গুলো দেখে। তারা যখন পরদায় তাদেরই সমবয়সিদের কটু কথা বলতে বা দুর্ব্যবহার করতে দেখে, তাদের মনে সেটা কী প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি যে শিশু অভিনেতারা এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করছে, তাদেরও নিষ্পাপ মনে অজান্তেই কুপ্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তাই শুধু টিআরপি’র লোভেই বাচ্চাদের দিয়ে সব রকম অভিনয় করিয়ে নেওয়াটা সকলে মানতে পারছেন না।

সাধারণ মানুষের গল্পে আর মন গলছে না দর্শকের। তাই সুপারন্যাচারালের দিকে ঝুঁকছেন নির্মাতারা। এমনিতে তা নিয়ে সমস্যা ছিল না। কিন্তু রামায়ণ, মহাভারত, শিব-পার্বতী, গণেশ-সরস্বতীর গল্পের সব রকম ভার্সন ছোট পরদায় দেখানো হয়ে গিয়েছে বলে বিষয়টা বেশ গোলমেলে হয়ে গিয়েছে। দত্যি-দানো, ইচ্ছাধারী নাগিন, ডাইনি সকলের ভিড়ে গল্পগুলো কেমন হাস্যকর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যখন এই চরিত্রগুলো গল্পের বাকি ‘স্বাভাবিক’ চরিত্রদের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করল! শুধু তাই নয়, এই গল্পগুলোর জনপ্রিয়তাও হু হু করে বেড়ে চলেছে। তাই একদিকে যখন নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওর সিরিজগুলো দেখার জন্য ভারতীয়রা সাবস্ক্রিপশন নিচ্ছেন, দশর্কের একটা বড় অংশ সিমরকে মাছি হয়ে যেতে দেখেও আনন্দ পাচ্ছেন! কিংবা মৌনী রায়কে ‘সেক্সিয়েস্ট নাগিন’এর (একধিক নাগিন ছোট পরদায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন কি না) খেতাব দিচ্ছেন! দেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনতাকে আরও বেশি ইন্ধন জোগানোর খুব কি প্রয়োজন আছে?

বাংলা-হিন্দি নির্বিশেষে ছোট পরদার হিরোরা পলিগ্যামাস হয়ে উঠছে। এই ট্রেন্ডটা অবশ্য অনেকদিনেরই। ত্রিকোণ প্রেমের জনপ্রিয়তা বহু যুগ ধরে। কিন্তু সেটা টিকিয়ে রাখার জন্য কত কী করছেন নির্মাতারা! কারও স্মৃতিভ্রম, কারও বিয়েটাই দুর্ঘটনা, কারও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা! বাংলার প্রায় সব সিরিয়ালেই যেন হিরোর দু’টো বউ থাকা বাধ্যতামূলক। মানে খাতায়-কলমে না হলেও কোনও না কোনও নাটকীয় ছলচাতুরিতে দু’টো বউ জোগাড় হয়েই যায়! দেশে যেখানে ‘তিন তালাক’ নিয়ে মেয়েরা লড়ছেন, সেখানে টেলিভিশনে কারও ডিভোর্স নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই নেই। যে যখন পারছে, বিয়ে করে নিচ্ছে।

পণের জন্য বাড়ির বউয়ের উপর অত্যাচার বা খুনের ঘটনা এখন নিত্যদিনের খবর হয়ে গিয়েছে। যে দেশে গার্হস্থ্য হিংসার সমস্যা এতটাই প্রকট, সেখানে টেলিভিশনের মতো মাধ্যমে এই ধরনের ঘটনাগুলো নিয়ে রং চড়িয়ে গল্প বললে, সেটা কিছু নৈতিক প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। কারণ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ টেলিভিশন দেখেন। বাংলা কিংবা হিন্দি ধারাবাহিকের প্রায় সব মুখ্য জুটির মধ্যেই বিস্তর আর্থ-সামাজিক ফারাক দেখা যায়। একজন খুব বড়লোক, অন্যজন নিম্নবিত্ত (এখনকার টেলিভিশনে মধ্যবিত্তের তেমন জায়গা নেই)। তাঁদের হয় প্রেম করে বিয়ে হয়, না হয় কোনও রকম পরিস্থিতির চাপে পড়ে (পরিস্থিতির চাপগুলো অবশ্য বাস্তব জগতের কাছে উটকো)! বিয়ের পর বাড়ির অন্য সদস্যরা তাকে দেখতে পারে না, তার সঙ্গে নানা রকম শয়তানি করে, কথায় কথায় গালমন্দও করে। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুরির দায়ে ফাঁসানোরও চেষ্টা করে। ‘ক্লাস ডিভিশন’কে উদ্‌যাপন করাই যেন ছোট পরদার উদ্দেশ্য। অনেক গল্প আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে। সটান চড়, অপহরণের চেষ্টা, খুনের ষড়যন্ত্র— নাটকীয়তা বাড়াতে সব মেশানো হয় প্লটে। পাশের বাড়ির লোকগুলো যে সেগুলো দেখে বাড়ির নিরীহ বউটার জন্য ফাঁদ পাতছে না, সেই গ্যারান্টি কি নির্মাতারা দিতে পারবেন?

ধূসর চরিত্রের কোনও অস্তিত্ব নেই ছোট পরদার জগতে। হয় আদর্শ নারীচরিত্র হতে হবে। না হয় একেবারে ভ্যাম্প! ছেলেদের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। বড়জোর কমিক চরিত্র হতে পারে। সিরিয়ালের মুখ্যচরিত্রে কখনও কোনও কর্মরত, স্বাবলম্বী নারীকে দেখতে পাই না আমরা। সকলেই প্রেমে পড়ে সংসার পাতে। নতুন জীবনের খোঁজে কোনও ডিভোর্সি মহিলা, অসমবয়স্কদের প্রেম, সিঙ্গল মাদার বা সন্তানহীন মেয়েরা বোধহয় মেনস্ট্রিম টেলিভিশনে জায়গা করে নেওয়ার মতো গুরুত্ব এখনও পায়নি!



মন্তব্য চালু নেই