বাজেটে জনস্বার্থ-জনদুর্ভোগ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে। এ নিয়ে গত ২ দিন থেকে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণে মতামত ব্যক্ত করছেন, টেলিভিশন টক শোগুলোতেও টানা আলোচনা চলছে । পত্রপত্রিকাও কম লেখালেখি হচ্ছে না । সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে আগ্রহ একেবারেই কম নয়। তারাও বুঝতে চায়, বাজেট কি ধরনের প্রভাব ফেলবে জনজীবনে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমিও সরকার পক্ষ ও বিভিন্ন মহলের বক্তব্য থেকে বিষয়টি একটু বুঝার চেষ্টা করেছি। যেহেতু ছাত্রজীবনে অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করার সৌভাগ্য হয়নি, তাই এ বিষয়ে আমার জ্ঞান যতসামান্য।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, গবেষণা করেছি শিক্ষা নিয়ে, সেহেতু রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠানোর পাশাপাশি অর্থনীতির উপর দু’একটি কোর্স পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তাতে বাজেট সম্পর্কে যা বুঝেছি তাতে, বাজেট- যে কোনো রাষ্ট্রের আয়না স্বরূপ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমরা যেমন নিজের চেহারার সব খুটিনাটি দেখতে পাই, তেমনি বাজেটের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। কিন্তু এই আয়নায় রাষ্ট্রের চেহারা দেখার বিষয়টি আমরা সাধারণ মানুষ কতটুকুই বা বুঝি, আর কতটুকুই বা খোঁজ রাখি। ফলে প্রতি বছর বাজেট পেশের পর দেশের বিশিষ্টজন, অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা যা বলেন, তা থেকেই আমরা অধিকাংশ নাগরিক বাজেটের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো কমবেশি বুঝার চেষ্টা করে থাকি।

এবারও বাজেট পেশের পর বেশ আলোচনা-সমালোচনা জমে উঠেছে। সরকারের অর্থমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা বলছেন, এটি একটি বাস্তবধর্মী উত্তম বাজেট হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তো বলেই ফেলেছেন- উত্তম বাজেট পেশের জন্য অর্থমন্ত্রী গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে গেছেন। অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপির নেতারা বলেছেন ‘ভুয়া সরকারের একটি ভূয়া বাজেট’ হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দৈন্যতায় রাজনীতিবিদরা নিজেদের সুবিধামত বাজেট নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। ফলে তাদের বক্তব্য থেকে আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কিছু নেয়ার মতো আছে বলে আমার মনে হয় না।

তবে দেশের অর্থনীতি নিয়ে যারা একটু ঘাটাঘাটি করেন, অতীতে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন কিংবা অর্থনীতিতে শিক্ষকতা করেন এমন ব্যক্তিদের বক্তব্য আমাদের খোরাক হতে পারে। তাদের বক্তব্য বিবৃতি থেকে উত্থাপিত বাজেটকে বুঝার মতো অনেক কিছু আছে বলে আমি মনে করি। ফলে গত দুই- দিনে সবার বক্তব্য বিবৃতি থেকে যা বুঝেছি তাতে আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানের আলোকে বাজেটের কতগুলো ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিম্নে তুলে ধরার ছেষ্টা করলাম।

প্রথমেই আসি বাজেটের আকার নিয়ে- গেল বৃহস্পতিবার আমাদের অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশের ইতিহাসে ৪৫তম তথা প্রস্তাবিত ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের দুই লাখ ৯৫,১০০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন। যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বাজেটের আকার ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।

এতে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা আদায় করা হবে। এনবিআর-বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। কর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা।

বাজেট নিয়ে যে যেভাবেই আলোচনা-সমালোচনা করুন কেন, এই বাজেটের কতগুলো ভাল ও মন্দ দিক রয়েছে। যা নাগরিক জীবনে ইতিবাচক ও নেতিকবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমেই আসি এর দূর্বল দিকগুলো নিয়ে-

প্রথমত: দেশের প্রবৃদ্ধি গেল কয়েক বছর ধরে ৫-৬ এর মধ্যে আটকে থাকছে। সেখানে এই বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ । ফলে হঠাৎ করেই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন কিভাবে হবে তার কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা নেই এই বাজেটে। ফলে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া হঠাৎ করেই প্রবৃদ্ধি বাড়ার কৌশলপত্রও এ বাজেট নয়। নিসন্দেহে এই বাজেটে বিনিয়োগ ও শিল্পক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য আর বাচনভঙ্গি থেকে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে-মূলত বিদেশি বিনিয়োগের কথা মাথায় রেখে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে দেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো পলিসি ভিশন নেই। আমরা সবাই জানি গেল দুই-তিন বছর থেকে দেশীয় বিনিয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। এতে অর্থণীতি অনেকটাই চাপের মধ্যে রয়েছে। ফলে দেশীয় বিনিয়োগ না বাড়লে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সত্যিই অলিক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত: প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য যে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। এ বিষয়ে বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপের কথা বলা নেই। যা কিছু বলা আছে, তা একেবারেই গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে কর্মসংস্থানের জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ বাড়ানো ও দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন সেটা এই বাজেটে নেই। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে কথা বলা হয়েছে তা অর্থমন্ত্রীর কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।আর নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তাতেও অন্তত: আমার সন্দেহ নেই।

তৃতীয়ত : বাজেটে যে ব্যয়ের বিশাল আকার ধরা হয়েছে তা পূরণ করতে যে অর্থের যোগান কোথা থেকে হবে সে ব্যাপারে কোন স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়নি। সামগ্রিক আয় সংস্থান করতে গিয়ে বৃহৎ ব্যয় সংকুলান করার জন্য বিভিন্ন ধরনের আয়ের উৎসে অবাস্তব ধরনের বৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা কোনোভাবেই বাস্তব নয়। ফলে বাজেটের যে স্ফীতি, তার বাস্তবসম্মত পরিসংখ্যানগত ভিত্তি নেই। কিছু কিছু জায়গায় ব্যাপক ধরনের স্ফীতি দেখানো হয়েছে, কিন্তু সেগুলো কী ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যম অর্জিত হবে- এ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। সরকার রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে, তার একটি বড় অংশ অর্জিত না হবার সম্ভাবনাই বেশী। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরনের ক্ষেত্রে যে ধরনের সুনির্দিষ্ট পথনকশার প্রয়োজন, সেটি এ বাজেটে নেই।

ফলে কোথা থেকে, কীভাবে এ অর্থের সংস্থান হবে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। স্বাভাবিকভাবেই আয়ের লক্ষ্য পূরণ না হলে বাজেটে ঘোষিত অন্যান্য লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। তাই বাজেটের আকার নয়, অর্থায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। এতে বাজেটের বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

চতুর্থত: এ উচ্চভিলাসী বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা চাপানো হয়েছে তাতে করে দেশের মানুষের অবস্থা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, বরং আরো খারাপ হবে। এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস । এর ওপর আবার বাড়তি করের বোঝা।

পঞ্চমত: প্রস্তাবিত বাজেটে তৈরি পোশাক শিল্পের উৎসে কর প্রায় আড়াই গুণ বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। বাজেটে তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি মূল্যের উপর আরোপিত বর্তমান দশমিক ৩০ শতাংশ উৎস কর ২৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অন্য সব রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রেও রপ্তানি মূল্যের উপর উৎসে করহার দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে একই করহারকে চূড়ান্ত কর হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ষষ্ঠত: কৃষকরা যে পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপের কথা বলা নেই এই বাজেটে। ফলে দেশীয় উৎপাদনের বৃহৎ ক্ষেত্রটির বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেই। ফলে এটা সার্বিকভাবে অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত মোট বাজেটে সামগ্রিক কৃষি খাতের অংশ ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে তা নেমে হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বরাদ্দের বড় অংশই ভর্তুকি। ফলে এটা কৃষিখাতের জন্য খুবই দু:সংবাদ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষকদের উপর।

সপ্তমত: নতুন অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে তা ছিল ১১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার মোট বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের অংশ মাত্র ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। অথচ বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ একই রকম আছে, দশমিক ৭৪ শতাংশ। পাঁচ বছর আগেও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ছিল জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতের এই বরাদ্দ হতাশাজনক। এতে জনস্বাস্থ্যের দিকে সরকারের গুরুত্ব ও মনোযোগের বিষয়টি উপক্ষেতি হয়েছে। এই বরাদ্দে চিকিৎসা নিতে মানুষের পকেটের খরচ বাড়বে। এতে দরিদ্রজনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা পাওয়া যে কঠিন হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

অষ্টমত: প্রস্তাবিত বাজেটে টাকার অঙ্কে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বেড়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ১৭ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা ১৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি এক করে দেখানো হয়েছে। সব মিলিয়ে এই খাত বরাদ্দ পেয়েছে ৩৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।

এবারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ১৬ শতাংশ। যা আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশের চেয়েও অনেক কম। অথচ ইউনেসকোর সুপারিশ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের বরাদ্দ হওয়া উচিত জিডিপির ৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী বক্তৃতায় শিক্ষা খাত গুরুত্ব পেলেও বাস্তবে বরাদ্দে গুরুত্ব পায়নি। ফলে এটা মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে।

নবমত: মোবাইল ফোনের সিম ও রিম প্রদত্ত সেবার ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের সরাসরি জনগণের উপর প্রভাব পড়বে। এ ধরনের শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি স্তর নির্ধারণ না করেই এটা করা কোনো মতেই ঠিক হয়নি।

এছাড়াও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাজেটে জনগণের জীবনে নেতিকবাচক প্রভাব ফেলার মতো প্রস্তাব রাখা হয়েছে। যা একটি জনকল্যাণমূলক বাজেটের অন্তরায়।

এই বাজেট নিয়ে সরকারের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস। রাজনৈতিক অস্থিরতার বছরে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি। সব সূচকই বলছে, অর্থনীতির কাঠামো এখন বেশ শক্তপোক্ত। সরকারের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, দেশে রাজনৈতিক প্রতিকূলতা তারা ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছে। মধ্যমেয়াদে সম্ভাবনাও বেশ আশাপ্রদ। ফলে অনেক নেতিবাচক দিক থাকাসত্ত্বেও এই বাজেটেই কিছু ইতিবাচক দিক্ও রয়েছে বলে আমি মনে করি।

প্রথমত: ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় থাকবে এটা নিসন্দেহে বলা যায়। এক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সৌভাগ্যবান বলবো। তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশে জিনিসপত্রের দাম (মূল্যস্ফীতি) ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারের চেয়ে বেশী ভাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে এই সীমার মধ্যে না থাকলেও তবে আগের মতো অস্বাভাবিক ভাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, এমন সময় বাজেট উত্থাপন করেছেন যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেল দাম ও সোনার দাম অনেক নেমে এসেছে। এছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এর আগে তিনি চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের কম থাকবে বলে আশা করেছিলেন। এপ্রিল পর্যন্ত বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ দাঁড়িয়েছে বলে তিনি সংসদকে জানান। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ পণ্যমূল্য হ্রাস, সন্তোষজনক কৃষি উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ সরবরাহ পরিস্থিতির ধারাবাহিক উন্নয়ন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্ক মুদ্রানীতির প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

দ্বিতীয়ত: প্রথমবারের বাজেটে ‘শিশু বাজেট’ একটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফলে এটা খুবই ইতিবাচক দিক। শিশুদের জন্য প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের বাজেটে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শিশু বাজেট একটি সর্ব মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয়। একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু বাজেট প্রণয়ন করতে হলে সকল মন্ত্রণালয়াধীন শিশুকল্যাণ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমসমূহ বিবেচনায় নিতে হবে। সকল মন্ত্রণালয়ের শিশুকল্যাণ সংক্রান্ত কাজগুলো চিহ্নিত করার জন্য সরকার কাজ করছে জানিয়ে মুহিত বলেন, আমরা শীঘ্রই -স্ট্রেন্থেনিং ক্যাপাসিটি ফর চাইল্ড ফোকাসড বাজেটিং ইন বাংলাদেশ (এসসি-সিএফবি) শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছি যার কার্যক্রম আগামী জুলাই-২০১৫ থেকে শুরু হবে।

তৃতীয়ত: আর্থিক খাত সংস্কারে একটি কমিশন গঠনের ব্যাপারে বাজেটে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটা বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য ভাল দিক। এরফলে আর্থিকখাতে বড় ধরনের পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা রয়েছে।

চতুর্থত: বেশকিছু শিল্পের কাঁচামাল শুল্ক কমানো ও ব্যক্তি খাতের আয়করের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার মতো ইতিবাচক দিক রয়েছে। চলতি বাজেটে করপোরেট ট্যাক্সের হার কমানো হয়েছে যা অন্যতম একটি ইতিবাচক দিক। ব্যক্তি খাতে করের সীমা ও বেশ কয়েকটি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, যা বাজেটের ভালো দিক। তাছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর কারণে অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে বলে ধারণা করা যায়।

সবশেষে বলবো, বাজেটের বাস্তবায়ন উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। তাই উন্নয়নের গতিকে ধরে রাখতে ( আয়-ব্যয়) পরস্পরের প্রতি সহনশীল থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে সেটার উপরই নির্ভর করছে এই বাজেটের সুফল । অনেকে এই বাজেটকে উচ্চাবিলাসী ও রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট বললেও এক্ষেত্রে আমি বলবো- সব ক্ষেত্রেই উচ্চাকাঙ্খা উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। ফলে বাজেটের ক্ষেত্রেও উচ্চাবিলাস দোষের কিছু নয়, যদি সেটা বাস্তবতার সাথে মিল থাকে। তাই প্রত্যাশা থাকবে, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে।

লেখক: গবেষক ও কলামলেখক । ই-মেইল:[email protected]



মন্তব্য চালু নেই