বাসা ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে ব্যাচেলরদের

ব্যাচেলরদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়া মালিকদের অনীহায় নতুন ‘বাহানা’ হিসেবে যুক্ত হয়েছে জঙ্গি ইস্যু। সম্প্রতি সংঘটিত ভয়াবহ দুটি হামলা এবং মেসে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান ও অভিযানে হতাহতের সবাই বয়সে তরুণ, ব্যাচেলর হওয়ায় ভাড়া দিতে অনাগ্রহ বেড়েছে। অনেক বাড়িওয়ালা বাসা ছাড়ার নোটিশও দিয়েছেন।

রাজধানীর কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ধানমণ্ডি, আজিমপুরসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাচেলররা নতুন কোনো বাড়িতে ফ্ল্যাট বা রুম ভাড়া নিতে পারছেন না। নিজেদের নিরাপত্তার কথা বলে ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না মালিকরা।

তা ছাড়া জঙ্গি তৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ায় বাড়িওয়ালারা আতঙ্কিত হয়ে বাসা ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না।

সর্বশেষ কল্যাণপুরে এক মেসে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহতের পর ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া না দেয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই এলাকার বাড়িওয়ালারা। মসজিদ কমিটিও তাতে সায় দিয়েছে।

এ সংকটকালে উল্টো ‘সুযোগ’ নিচ্ছে কিছু বাড়িওয়ালা। তারা বলছে, থাকতে হলে বেশি ভাড়া দিতে হবে। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে অনেক তরুণকে।

রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে বেশ কিছু কলেজ। প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় লাখের বেশি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অসংখ্য শিক্ষার্থী থাকলেও তাদের আবাসন ব্যবস্থা নেই। প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিকের পর বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী আসছে ঢাকায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাহিয়ান খান নাহিদ জানান, হলে সিট না পেয়ে থাকছেন আজিমপুরের একটি পুরনো বাড়িতে। মালিক বাড়িটি ডেভেলপারদের দিয়ে দেয়ায় আগস্ট থেকে নতুন বাসায় উঠতে হবে। বাসা খুঁজতে গিয়ে পড়েছেন মহাবিপদে। ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না কেউ।

“বাড়ির সামনে টু-লেট বোর্ডে স্পষ্ট করে লেখা থাকছে ‘ব্যাচেলর নিষেধ”, বলেন নাহিদ।

মিরপুরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইনুল ইসলাম জানান, ঈদ শেষে ঢাকা আসার পর বাড়িওয়ালা তাকে আগস্টে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। বাসায় আর ব্যাচেলর রাখা হবে না বলে জানিয়েছে বাড়িওয়ালা।

কল্যাণপুরে ৯ জঙ্গি নিহতের পর সে এলাকায় ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া না দেয়ার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ জানিয়েছে আশা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান। তিনি বলেছেন, ‘বাড়ি ভাড়া দিলে ভাড়াটিয়াদের তথ্য থানায় দেয়ার কথা। সেটা বাড়ি মালিকরা করছেন না, ভাড়ার তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে।’

কল্যাণপুরের সমাজ কল্যাণ মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমরা বাড়িওয়ালারা আলোচনা করি। সিদ্ধান্ত নিই, ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়া যাবে না।’

এ ছাড়া ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম ঠিকভাবে পূরণ করে মালিক সমিতি বা থানায় দেয়া হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে মনিটরিং টিম করা হবে বলেও জানান ওই নেতা।

প্রথমে বাসা ছাড়ার হুমকি দিয়ে পরে ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ মোহাম্মদপুরের এক কলেজ পড়ুয়া ফজলে রাব্বির। তিনি বলেন, ‘মাসের মাঝখানে এসে মালিক বলছে বাসা ছাড়তে হবে। বোঝানোর পর রাজি হলেও এক হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার শর্ত দেয়।’

একই অভিযোগ করেন উত্তরার বেসরকারি চাকুরিজীবী আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে আমরা চারজন থাকি। এই মাসে হুট করে মালিক বলেছেন, ব্যাচেলর রাখবেন না। ব্যাচেলর রাখা অনেক রিস্ক জানিয়ে বলেছেন, ভাড়া দুই হাজার বাড়িয়ে দিলে রাজি।’

নিরাপত্তার জন্য ব্যাচেলরদের বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ধানমণ্ডির জিগাতলার বাড়িওয়ালা নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ‘কেউ জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আমাকেও ঝামেলায় পোহাতে হবে। সে জন্য ব্যাচেলর না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

ভাড়াটিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জান্নাত ফাতেমাও স্বীকার করলেন ব্যাচেলরদের ভাড়া-দুর্ভোগের কথা। তিনি বলেন, ‘সমস্যাটা আগে থেকেই ছিল। এখন সেটা আরও বেড়েছে। আমরা এ বিষয়ে অচিরেই কর্মসূচি দেব।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মাসুম আরেফিন বলেছেন, ‘বাড়ির মালিক একতরফা ভাড়া বাড়াতে পারেন না। বাড়ি বাড়া নিয়ে ঝামেলা হলে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-এর আওতায় রেন্ট কোর্টের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ আছে।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘শুধু ব্যাচেলর নয়, সব ভাড়াটিয়াকেই সঠিকভাবে ভাড়াটিয়া ফরম পূরণ করতে হবে। ওই ফরম থেকে ভাড়াটিয়ার পিসিআর (অতীতের অপরাধ নথি) যাচাই করে সন্দেহজনক মনে হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যারা অপরাধে জড়িত নয়, তাদেরকে বাড়ি ভাড়া দিতে বাধা নেই।’



মন্তব্য চালু নেই