বাড়িতে ওমরান, সমুদ্রে আইলান-কোথায় যাবে সিরীয় শিশুরা?

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া। একের পর এক হামলায় বিপর্যস্ত সেখানকার জনজীবন। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানে হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ তাদের মিত্ররা।

এ হামলার শিকার শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও। সিরিয়ার মানুষের অসহায় জীবন মানুষের মনকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিচ্ছে। তাদের বেঁচে থাকার লড়াই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।

সিরীয় শিশুদের অসহায় জীবনের চিত্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনার সৃষ্টি হয় সমুদ্রতীরে পড়ে থাকা দেশটির তিন বছরের শিশু আইলান কুর্দির নিথর দেহের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটির নাগরিক আবদুল্লাহ কুর্দি তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান- পাঁচ বছর বয়সী গালিব কুর্দি ও তিন বছর বয়সী আইলান কুর্দিকে নিয়ে পালিয়ে তুরস্কে চলে যান।

পরে তুরস্কের বদ্রাম উপদ্বীপ থেকে নৌকায় করে সমুদ্রপথে গ্রীসে যাওয়ার সময় নৌকাটি ডুবে গেলে সমুদ্রে তলিয়ে যায় আবদুল্লাহর স্ত্রী ও সন্তানরা।

পরে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে শিশু আইলানের মৃতদেহ তুরস্কের উপকূলে পৌঁছায়। লাল টি-শার্ট, নীল প্যান্ট ও কালো জুতা পরা নিথর শিশুটির দেহ, যার ওপর দফায় দফায় আছড়ে পড়েছে সাগরের ঢেউ।

শিশু আইলান কুর্দির নিথর দেহ সাগরপাড়ে পড়ে থাকার ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়। যুদ্ধের কারণে যেসব শরণার্থী ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছিল, তাদের অনুমতি দেয়া হয়। কয়েক হাজার শরণার্থী জার্মান-অস্ট্রিয়াসহ কয়েকটি দেশে ঢোকার অনুমতি পায়।

তবে যারা নিজের দেশ ছেড়ে অন্যদেশে যাওয়ার পক্ষে নয় তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?

শিশু আইলানের ঘটনার ১১ মাস পর আরেক শিশু ওমরান দাকনিশের ঘটনা বিশ্বব্যাপী তুমুল সমালোচনার ঝড় তুলেছে। ওমরান দাকনিশকে উদ্ধারের ভিডিও ও ছবি বুধবার ছড়িয়ে পড়লে তা ফের সারা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, রক্তাক্ত, সারা গায়ে ধূলি মাখা ভীত শিশুটি একটি অ্যাম্বুলেন্সের সিটে বসে রয়েছে, একটু পরেই সে নিজের মুখে হাত বুলিয়ে রক্ত দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে।

সম্প্রতি সিরিয়ার আলেপ্পোয় বিমান হামলার পর একটি বিধ্বস্ত ভবন থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। এরপর তার ভিডিও আর ছবি প্রকাশ করে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা।

ওমরান দাকনিশ মাথায় আঘাত পেয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, চিকিৎসার পর ওমরান এখন সুস্থ ও ভালো আছে।

প্রথমে তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে তেমন তথ্য জানা যায়নি। তবে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ওই হামলার ঘটনায় ওমরানের পরিবারের সদস্যরাও বেঁচে রয়েছেন এবং তারা গুরুতর আহত।

আলেপ্পোতে কয়েক সপ্তাহ ধরেই সিরীয় বিদ্রোহী আর সরকারি বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে। সহিংসতায় কয়েকশ’ মানুষ নিহত হয়েছে।

বিদ্রোহীদের একটি মিডিয়া সেন্টার জানিয়েছে, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পোর কোটের্জি জেলার একটি ভবনে রাশিয়ান বিমান হামলার পর ওই শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। সে সময় এই ছবিটি তোলা হয়। ওই হামলায় তিনজন নিহত আর ১২ জন আহত হন।

হামলার পর ভবনে উদ্ধার অভিযানের সময় ফটোসাংবাদিক মাহমুদ রাসলান ওমরান দাকনিশের ভিডিওটি ধারণ করেন। পরে সেটি আলেপ্পোর মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, একটি বিধ্বস্ত ভবন থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সের আসনে রক্ত আর ধূলোমাখা শিশুটিকে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এরপর সে খানিকক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থাকে। তারপর নিজের মুখে হাত বুলিয়ে, হাতে রক্ত দেখতে পেয়ে চমকে যায়। এরপর সেই রক্ত সে অ্যাম্বুলেন্সের সিটে মুছে ফেলার চেষ্টা করে।

বিরোধী সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের একজন সদস্য বলছেন, এই ছবিটি প্রমাণ করছে, সিরিয়ায় কী ভয়াবহতা চলছে।

‘সাদা হেলমেট’ বাহিনীর ফটোগ্রাফার খালিদ খতিব জানান, তিন বছর ধরে সিরিয়ার বিপদসংকুল পরিবেশে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাদা হেলমেট। ইতিমধ্যে সংগঠনটির সদস্যরা ৬০ হাজার মানুষের জীবনকে রক্ষা করেছে।

খালিদ খতিব বলেন, ‘এখানে ওমরানের মতো ঘটনা নিত্যদিনের। আমি অসংখ্য শিশুর এমন রক্তমাখা ছবি তুলেছি, যা আমার জন্য খুবই কষ্টকর।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওমরান দাকনিশের ছবি দেখে বিশ্বের যে সব মানুষ মায়ার বন্যা ছড়াচ্ছেন, আমি তাদের ঘৃণা করি। আমি যত শিশুর কান্না, আহত ও নিহত হওয়া দেখি, ততই ঘৃণা বেড়ে যায়।’

দ্য সিরিয়ান অবজাভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্যে, ২০১০ সাল থেকে সিরিয়ায় চলা সংঘর্ষে ১৪ হাজারের বেশি শিশু নিহত হয়েছে।

এসব শিশু নিহতের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী প্রশ্ন- আইলান থেকে ওমরান, কোথায় যাবে সিরীয় শিশুরা?



মন্তব্য চালু নেই