বিএনপির ঐক্যের ডাকে ‘সন্দেহ’ দেখছে আওয়ামী লীগ

বিএনপির জঙ্গিবাদবিরোধী ঐক্যের ডাককে সন্দেহের চোখে দেখছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, বিএনপির ঐক্যের আহ্বান একটি সরকারবিরোধী তৎপরতা, আলোচনায় থেকে রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানো এবং সরকারকে ব্যর্থ চিহ্নিত করে চাপে ফেলা। তাই রাজনীতির মাঠে বিচ্ছিন্ন ও অনানুষ্ঠানিকভাবে শাসক দলের পক্ষ থেকে নানা কথা বলা হলেও সংসদের বাইরে থাকা দলটির ঐক্যের ডাকে সাড়া দেয়ার কোনো চিন্তাও নেই সরকারি দলের।

আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কয়েক নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তারা বলছেন, এ মুহূর্তে বিএনপির ঐক্যের ডাকে সাড়া দেয়া হবে আওয়ামী লীগের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত। দলের নেতাকর্মীদের মাঝে যেমন বিভ্রান্তি ছড়াবে, তেমনি নিজেদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসলে রাজনীতিতে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখেও পড়তে হবে। আর জঙ্গি দমনে দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, সরকার পতনে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন ও পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যার পর, গুপ্ত হত্যা ও জঙ্গি হামলায়ও বিএনপি জোটের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ করছে দেশের জনগণ। নিজ দল ও জোটের সন্ত্রাসীদের রক্ষা করতেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিএনপি জাতীয় ঐক্যের নামে সরকার হটানোর ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, অনেকে আজ ঐক্য চাচ্ছেন, সেই ঐক্য হতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য এবং দেশের জনগণের ঐক্য।

আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও সরকারের মন্ত্রী ঐক্যের জন্য বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার শর্ত দিলেও তা কেবল কাউন্টার পলিটিক্স। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি যেমন সরকারকে ঐক্যের জন্য চাপ দিয়ে বলছে আওয়ামী লীগ ঐক্য চায় না, জঙ্গি দমনে আন্তরিক নয়। তেমনি এ বিষয়টি ফেস করার জন্যই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঐক্যের জন্য শর্তারোপ করা হচ্ছে। জামায়াত ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্য, খালেদা জিয়ার ক্ষমা চাওয়া এসব শর্তের বিষয়েও দলীয় কোনো ফোরামে আলোচনা হয়নি।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, কিসের ঐক্য, বিএনপির সঙ্গে কেন ঐক্য করতে হবে। দেশের জনগণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, বিএনপির যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে তাদের দলের ও জোটের কেউ জড়িত আছে কিনা, কিংবা জঙ্গি সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাদের কাছে থাকলে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দিতে পারে।

গুলশানের ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলার পরদিন ২ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণে দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে একই আহ্বান জানান বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও। এর পরই সরকারি দলের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের আহ্বান জানায় বিএনপি।

শাসক দলের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ঐক্যের আহ্বানের বিষয়ে ভাবতে দলের হাইকমান্ডের বেশি সময় লাগেনি। সন্ত্রাসী হামলাকে যারা ‘রক্তাক্ত অভ্যুত্থান’ আখ্যা দেয় তাদের সঙ্গে ঐক্য কিসের? বিএনপির ঐক্যের আহ্বানের ‘ফাঁদে’ পা দিলে রাজনীতিতে পর্যুদস্ত বিএনপিই লাভবান হবে। শাসক দলের উচ্চ পর্যায়ের কয়েক নেতা জানান, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন, পেট্রলবোমা, এত রক্ত আর প্রাণহানির পর এখন বিএনপির ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দিলে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। এ ছাড়া জঙ্গি দমনে দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। জনমনে প্রশ্ন উঠবে সরকার চাপে পড়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য গড়েছে।

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিএনপির জাতীয় ঐক্যের ডাককে বলেছেন তামাশা। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদী দল জামায়াতকে জোটে রেখে বিএনপির ঐক্যের আহ্বান রাজনীতিতে গুরুত্ব পাওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তোফায়েল বলেন, যে দল (জামায়াত) সন্ত্রাসী বা জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত, যাদের মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই দলকে সঙ্গে নিয়েই যদি থাকতে চায় বিএনপি, তবে তারা তাই থাকুক।

সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে বিএনপিকে পাশে পাওয়ার চেয়ে প্রচারণাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসন, স্থানীয় নাগরিক সমাজ, ইমাম ও জনপ্রিতিনিধিদের সঙ্গে এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সবাইকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতন ও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আর ১৪ দলীয় জোট শহীদ মিনারে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রতিবাদ সভা করেছে। এর পাশাপাশি সমমনা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গেও শাসক জোটের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গঠনে অভিভাবক ও নারী সমাবেশ করবে ১৪ দল। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ চলতি সপ্তাহেই জঙ্গিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ২২ জুলাই নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলায় এবং ২৩ জুলাই বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলায় অনুষ্ঠিত হবে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রতিরোধ সমাবেশ। এ ছাড়া র‌্যাব জঙ্গি সম্পর্কে তথ্য নিতে আধুনিক প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নিয়েছে। বিটিআরসি ইউটিউব বা অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যম থেকে জঙ্গিবাদী প্রচারণার সুযোগ রহিত করে দিচ্ছে। ফেসবুকেও যাতে এ প্রচার চলতে না পারে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া টেলিভিশন ও রেডিওতে ইতিমধ্যে মানবিক আবেদনধর্মী প্রচারণা শুরু হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে পরিবারের অভিভাবকরা যাতে সন্তান সম্পর্কে সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখেন এবং না রাখলে তার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আলেম-ওলামা ও ইমামদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক আলোচনা সভার কাজ শুরু করেছে। জঙ্গিবাদ দমনে সামাজিক-পারিবারিক সচেতনতা বাড়ানো ছাড়াও সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে জঙ্গি দমনে ভূমিকা রাখা ও জঙ্গি ধরিয়ে দিতে পারলে বড় অঙ্কের আর্থিক পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান। আর মূল কাজ করবে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই।

সরকারের দুই মন্ত্রী জানান, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে গৃহীত এই কৌশলগুলোতে অবশ্যই সুফল আসবে বলে আশা করছেন তারা। ওই দুই মন্ত্রীর মতে, বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসবাদের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। তাই এ ইস্যুতে তাদের সঙ্গে সরকারের ঐক্য বা আলোচনার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গি হামলাকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। কিন্তু সরকার তাদের এই সুযোগ দেবেÑ সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বিএনপি সরকারকে বিভিন্ন তথ্যভিত্তিক সহায়তা দেয়া ছাড়া জঙ্গি দমনে তাদের আদৌ কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ মনে করছে, গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলায় বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত বা সমর্থন থাকতে পারে। বিশেষ করে গুলশান হামলার ঘটনায় দেড় শ’ কোটি টাকা লেনদেন এবং তারেক রহমানকে জড়িয়ে শাসক দলের নেতারাও বক্তব্য দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিএনপির সঙ্গে ঐক্য বা আলোচনা করে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা যাবে না। কারণ এগুলোতে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে। তাই এ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ অবশ্যই নির্মূল হবে, সেটা সরকারের গৃহীত কৌশলের মধ্য দিয়েই।-মানবকণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই