‘বিচার’ চাইতে হয় কেন?

মধ্যযুগের রাজারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঘোষণা দিয়ে প্রজাদের শোষণ করতেন।
রুশোর সামাজিক চুক্তি অনুযায়ী, মানুষ নিজেরাই নিজেদের সুবিধার জন্য স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। নিজেরাই নিজেদের কিছু বিধি-নিষেধের আওতায় এনেছে।
সামাজিক ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র আজকের অবস্থানে এসেছে। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করবেন, তারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। অপরাধ প্রবণতা কমানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভূমিকা রাখবে, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করবে। পৃথিবীর খুব বেশি দেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী তা হয় না। যেসব দেশে হয় না, সেসব দেশের একেবারে প্রথম দিকে অবস্থান করছে বাংলাদেশ।
অপরাধ কমানো বা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের শাসকরা অবিশ্বাস্য রকমের উদাসীন। অপরাধের শাস্তি, বিচার চাইতে হয়, আন্দোলন করতে হয়। অথচ স্বাভাবিক নিয়মেই তা হওয়ার কথা। আবার যার যে কাজ করার কথা, সে কাজ কেউ করে না। ব্যস্ত থাকে অন্য কাজ নিয়ে, যা তার কাজ নয়।
বিচার এবং এসব প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা।
১. সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা রহস্য উন্মোচনের ৪৮ ঘণ্টার প্রতিশ্রুতি ৪৮ মাসেও পূরণ হয়নি। শুরুতে ‘বিচার চাই’ বিষয়ক আন্দোলন ছিল। সরকারের আর কিছু না হোক, কথার প্রতিশ্রুতি ছিল। এখন ‘বিচার চাই’ আন্দোলন নেই। সরকারের কোনও উদ্যোগও নেই।
২. ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। দীপনের স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা ‘বিচার চাই’ বিষয়ক আন্দোলন করলেন না। সরকার বিচারের কাছ দিয়েও হাঁটল না। আবার ‘বিচার চাই না’ বলে অপরাধী হয়ে যান দীপনের বাবা।
৩. যুবলীগ নেতা মিল্কীকে হত্যা করা হলো, সিসিটিভি ফুটেজে চিত্র থাকার পরও তদন্তের কোনও কূল-কিনারা নেই। মূল অভিযুক্ত হত্যাকারীকেও রাষ্ট্রীয় বাহিনী হত্যা করলো। ‘বিচার চাই’ বিষয়ক আন্দোলন নেই, তদন্ত বিচারের উদ্যোগও নেই।
৫. ত্বকী হত্যা মামলার আসামি ধরা পড়লো। আসামিরা স্বীকারোক্তি দিয়ে হত্যাকারীদের নাম বললো, তারপরও বিচার হলো না। ত্বকীর বাবা এখনও ‘বিচার চাই’ আন্দোলন করছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কান পর্যন্ত তা পৌঁছাচ্ছে না। হত্যাকারীদের পক্ষে রাষ্ট্রের স্পষ্ট অবস্থান।

৬. নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ হত্যা মামলার বাদীরা যে ‘বিচার চাই’ বলে আন্দোলন করবেন তারও উপায় নেই। প্রধান অভিযুক্ত হত্যাকারী নূর হোসেনের ক্যাডাররা পুরো এলাকা দখল করে নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নূর হোসেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, বাদীর বিপক্ষে! অবাক হবেন না, এটাই সত্যি, রাস্তায় নূর হোসেনের প্রিজন ভ্যান থামিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়, আদালতে অবাধে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নূর হোসেন।

আরেক অভিযুক্ত মন্ত্রীর জামাতা তারেক সাইদের কারাগারের রুমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়। অসুস্থতার অজুহাতে সুস্থ মানুষ হাসপাতালে থাকে। শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার মতো সাজগোজ করে আদালতে আসে।

হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের আত্মীয় পরিজন ‘বিচার চাই’ বলে নীরবে চোখের পানি ফেলেন।

৭. ঋণের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে জনগণের ৪ হাজার কোটি টাকা লুটেরা হল-মার্কের তানভীর নিজের গাড়িতে, কখনও অ্যাম্বুলেন্সে আদালতে আসে! একদল লোকের সঙ্গে গল্প করে, আড্ডা দেয়। ‘বিচার চাই’ বলারও কেউ নেই। ‘বিচার’ করারও কেউ নেই।

৮. নববর্ষে, প্রকাশ্যে সিসি ক্যামেরার সামনে টিএসসি এলাকায় নারীরা নির্যাতিত হলেন। ‘বিচার চাই’ আন্দোলনও হলো। ‘বিচার’ বাবুর দেখা মিলল না।

৯. সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি রাজনৈতিক প্রপাগান্ডায় মেতে উঠেছেন। কারণে অকারণে যিনি বিশিষ্টজনদের আদালত অবমাননার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখতেন, তিনি এখন প্রধান বিচারপতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন। কোনও আদালত ‘অবমাননা’ হচ্ছে না।

১০. ছাত্র সংগঠনের কাজ ছাত্রদের স্বার্থ দেখা। হলে থাকার জায়গা নেই, খাবার অত্যন্ত নিম্নমানের- এসব নিয়ে তাদের কোনও কথা নেই। তারা ব্যস্ত তদবির এবং ঠিকাদারি নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নয়, হল পরিচালনা করা, সিট বণ্টন, ছাত্রদের মাঝরাতে মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখা- সবই করে ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। তাদের অপকর্মের শিকার হাফিজউদ্দিন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেল। তাদের কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। হলের প্রভোস্ট অন্যায়-অপকর্ম সমর্থন করে কথা বলেন। আর বলেন ‘আমি কিছু জানি না’।

ছাত্রলীগ কখনও শহীদ মিনার দখল করে সিপি গ্যাংয়ের ব্যানারে তাণ্ডব চালায়, কখনও প্রথম আলো বন্ধের জন্যে মিছিল করে। এখন তারা মিছিল, আন্দোলন, মামলা করছে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে। ডেইলি স্টার বন্ধের জন্যে মিছিল করছে ছাত্রলীগ। এসবই এখন ছাত্রলীগের কাজ!

১১. ছাত্রলীগ ‘বিচার চায়’ মাহফুজ আনামের। তার অপরাধ, তিনি ডিজিএফআইয়ের পাঠানো সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। যারা সংবাদ সরবরাহ করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনও কথা নেই। যেসব দলীয় নেতা স্বীকারোক্তি দিয়ে নেত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রকাশ করলেন, তারা সবাই দলেই আছেন। তাদেরও কোনও অপরাধ নেই। সব অপরাধ মাহফুজ আনামের। কারণ তিনি তার ভুল স্বীকার করেছেন!!

১২. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একদিকে আর্থিক উন্নয়ন দৃশ্যমান। তার চেয়ে বেশি দৃশ্যমান অন্যায়-অনিয়ম দুর্নীতি। অপশাসনের প্রবল উপস্থিতি, সুশাসনের অনুপস্থিতি।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষতির দিকটি হলো, প্রতিষ্ঠানগুলো সব একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ জনমানুষের শিক্ষা বলতে কিছু থাকছে না। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শক্তিমত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য, তার কোনওটি অক্ষত থাকছে না। এমন ভঙ্গুর একটি প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা নিয়ে সক্ষম রাষ্ট্র তৈরি হতে পারে না। প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের ফল বাংলাদেশ আজ পাবে না, পাবে ২৫/৩০ বছর পর। তখন তার বেশিরভাগ জনমানুষ বৃদ্ধ হবে, কর্মক্ষম থাকবে না। এখন যারা সক্ষম তখন তারা হবেন দায়। নতুন সক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি হবে না। এমন একটি পরিস্থিতি ভাবলেও শঙ্কা হয়। আগে ‘বিচার চাইলে’ কখনও কখনও বিচার পাওয়া যেত। আস্তে আস্তে ‘বিচার চাই’ বলার মানুষও থাকছে না, থাকবে না। আমাদের শাসকরা হয়তো মধ্যযুগে ফিরে যাবেন। তারা নিজেদের ‘ঈশ্বর প্রেরিত রাজা’ ভাববেন, নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠার শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবেন।

লেখক: গোলাম মোর্তোজা, সম্পাদক, সাপ্তাহিক



মন্তব্য চালু নেই