বিচার না হলে বাবুলকে ঘিরে প্রশ্ন থেকেই যায়

কামাল আহমেদ : পুলিশ বাহিনীতে চৌকস অফিসার হিসেবে বাবুল আক্তারের একটা ইমেজ ছিল। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি তাঁর বাহিনীতে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন। কিন্তু ৫ জুন তাঁর স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর হত্যাকাণ্ড সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের ২০ দিন পর মধ্যরাতে তাঁকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে ১৫ ঘণ্টা পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের পর দেশজুড়ে বিস্ময়। সবার আলোচনা—তা সে ফেসবুকই হোক আর মুখোমুখি আড্ডা—সবখানেই প্রশ্ন, এই হত্যার আসল রহস্য কী?

বাবুল আক্তারকে যেভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে রকম আর কোনো নজির এ দেশে নেই (ভুল হলে পুলিশ বিভাগ শুধরে দিতে পারে)। উপরন্তু সদ্য মাতৃহীন দুই সন্তান এবং পরিবারের আর কারও সঙ্গে ওই জিজ্ঞাসাবাদের সময়কালে মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে যোগাযোগ করতে না দেওয়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। মিতু হত্যার তদন্ত ঘিরে রহস্য খোলাসা হওয়ার চেয়ে তা আরও জটিল হতে শুরু করেছে। কাকে রক্ষা করার চেষ্টা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। কেন অপরাধীকে রক্ষা বা আড়াল করতে হবে? ভাড়াটে খুনিরা আদালতে জবানবন্দি দিয়ে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়, কিন্তু তাদের যে বা যাঁরা ভাড়া করেছেন, তাঁদের পরিচয় জানা যাবে না, এমনটি মেনে নেওয়া কঠিন। অথচ তেমনটিই ঘটছে। প্রশ্ন উঠছে, অপরাধী নিশ্চয়ই এমন কেউ, যাঁকে রক্ষা করা জরুরি। গুঞ্জন রয়েছে, অপরাধের সঙ্গে জড়িত আরও একাধিক ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিম্মাতেই আছেন। তাহলে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মতো আবারও কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নাটক দেখতে হবে? রহস্য চাপা দেওয়ার মোক্ষম উপায় কি এখন এই বন্দুকযুদ্ধ?

পুলিশ বাহিনীর সুনাম বা ভাবমূর্তি রক্ষার প্রশ্ন কেন উঠছে? বাবুল আক্তারের প্রতি যাঁদের অগাধ আস্থা, তাঁরা (শ্বশুরসহ) বলছেন, পুলিশ বাহিনীতে তাঁর ‘সাফল্য ও বীরত্বে’ ঈর্ষাকাতর সহকর্মীদের কারও কারও ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। পুলিশ বাহিনীতে পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি সত্যিই এ রকম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে? নাকি দলীয় আনুগত্যের বিচারে কোনো বিভাজন রয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাহিনীর দৈনন্দিন কাজকর্মে? এ রকমটি হলে নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য তা বড়ই উদ্বেগের বিষয়। সরকারও কি এই উদ্বেগ থেকে মুক্ত?

গত রোববার চট্টগ্রামের আদালতে মিতু হত্যায় জড়িত যে দুজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁরা কেউই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন, এমন কথা বলেননি। পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, তাঁরা দুজন স্রেফ ভাড়াটে খুনি। অথচ শুরুতে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। আমরা মনে করতে পারি যে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে স্পষ্টতই বিএনপি-জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছিল। সংসদে বলা হয়েছিল, পরিবারের প্রতি যারা হাত তুলেছে, তাদের ছাড়া হবে না। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করে জঙ্গি-সমস্যাকে খাটো করা হচ্ছে এমন সমালোচনার জবাবে আমরা শুনেছি, বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন নাম নিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করলেও এদের হত্যার প্রক্রিয়া একই রকম।
তদন্ত শুরুর আগে এবং তদন্তের সময়েও রাজনৈতিক দোষারোপ দেখতে আমরা অভ্যস্ত। ফলে চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর তদন্ত রাজনৈতিক ধারাতেই পরিচালিত হতে থাকে এবং বিচারপ্রার্থীদের চোখের পানি মোছা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এমনটি বিএনপির আমলেও হয়েছে এবং তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বর্তমানের মন্ত্রী-সাংসদেরাও বলে থাকেন। অথচ তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার রাজনৈতিক দূষায়ণ বন্ধের বদলে তাঁরা তাতে উৎসাহ দিয়েই চলেছেন।

মিতু হত্যার পর আমরা দেখলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসন দ্রুত নড়েচড়ে বসল। দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয় ১০ জুন। তার আগেই ৫ জুন রাত থেকে ১০ জুন—এই পাঁচ দিনে সন্দেহভাজন ৫ জঙ্গি কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন। এক সপ্তাহের ওই অভিযানে গ্রেপ্তার হলেন ১৩ হাজারেরও বেশি লোক, যাঁদের মধ্যে পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী সন্দেহভাজন জঙ্গি মাত্র ১৯৪ জন। কিন্তু পুলিশের এই বাড়তি শক্তিপ্রয়োগে মিতু হত্যার জট খোলেনি।

নিষ্ঠুর যে হত্যাকাণ্ডে দুটি মাসুম বাচ্চা মাতৃহারা হলো, সেই হত্যাকাণ্ড নিয়েও রাজনীতি হয়েছে। কিন্তু তাতে রহস্য আরও জটিল হয়েছে। পুলিশ এবং সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অপরাধের বিচার হবে এমন আশা ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে। আর বিচার না হলে বাবুল আক্তার নিরপরাধ নাকি অপরাধী, তা যেমন স্পষ্ট হবে না, তেমনি পুলিশ বাহিনীর কথিত ভাবমূর্তিও প্রশ্নাতীত থাকবে না। –প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই