‘বিছানার অসংখ্য কীট-ই বাড়িয়ে তোলে অ্যালার্জি’

আগের তুলনায় বেড়ে চলেছে অ্যাজমা অর্থাৎ, হাঁপানি৷ কিন্তু, জানেন কি, হাঁপানি সেরে যায়? তা হলে, এই অসুখটা আসলে কী? অ্যাজমা কি অ্যালার্জির-ই প্রকাশ? আর, এই অসুখের চিকিৎসা মানেই কি ইনহেলার? না, চিকিৎসার অন্য পদ্ধতিও রয়েছে? শুধুমাত্র তাই নয়৷ অনেকে এমনও মনে করেন যে, শীতের সময়ই হাঁপানি বেড়ে যায়৷ সত্যিই তাই? তা হলে, এই অসুখ প্রতিরোধের উপায়-ই-বা কী? অ্যাজমার কোনও প্রতিষেধক আছে? এমনই বিভিন্ন বিষয়ে বলছেন ন্যাশনাল অ্যালার্জি অ্যাজমা ব্রঙ্কাইটিস ইনস্টিটিউট-এর অধিকর্তা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক আলোকগোপাল ঘোষাল৷

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক আলোকগোপাল ঘোষাল৷বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক আলোকগোপাল ঘোষাল৷
হাঁপানি যদি সারেই তা হলে লোকে হাঁপানিতে কষ্ট পায় কেন? মহাবলীপুরম আর উটপাখির গল্প: যাঁরা দক্ষিণ ভারতে মহাবলীপুরমে গিয়েছেন, দেখেছেন, একটি বিরাট প্রস্তর খণ্ড প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় শতাব্দীর পর শতাব্দী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ যাত্রীরা সেই ঝুলন্ত পাথরের নিচে বিশ্রাম নেন, প্রেম করেন এবং নিদ্রাও যান৷ পাথর নড়ে না৷ কিন্তু, পাথর যদি একবার গড়াতে শুরু করত? যত গড়ায়, তত তার গতিবেগ বাড়তে থাকে৷ অর্থাৎ, যত ক্ষণ শুধু বংশানুরা আছে, কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে disease threshold পার হয়নি তত ক্ষণ পৃথিবী সুন্দর৷ কিন্তু যেই লক্ষণরেখা পার হয়ে পাথর গড়াতে শুরু করবে তার গতিবেগ ক্রমশই বাড়তে থাকবে৷ তাই যত প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করা যাবে ততই মঙ্গল৷ অসুখ প্রকাশ পাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু করতে যত দেরি হবে, সম্পূর্ণ আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা ততটাই কমে যাবে৷

উটপাখি সম্বন্ধে শোনা যায়: মরুভূমিতে যখন শিকারিরা তাকে তাড়া করে, সে প্রথমে পালাবার চেষ্টা করে৷ প্রথমে দৌড়য়– পারে না, দেহের তুলনায় পা গুলো অত্যন্ত সরু৷ তার পরে ওড়বার চেষ্টা করে– তাও হয় না৷ ডানাগুলি ছোট ও অকেজো৷ তখন সে বালির মধ্যে চোখ বুজে মুখ ঢুকিয়ে দেয়৷ ভাবখানা এই যে, সে যখন দেখতে পাচ্ছে না তার শিকারিরাও তাকে দেখতে পাচ্ছে না৷ তো এই উটপাখি মনোবৃত্তিই হাঁপানি রোগীদের কষ্টে থাকার কারণ৷ হাঁচি থেকে কাশি, তার থেকে শ্বাসকষ্ট, রোগী প্রানপণ চেষ্টা করছে সত্যকে অস্বীকার করবার৷ চিকিৎসা তো হচ্ছেই না এমনকী রোগ নির্ণয়ও নয়৷ ফলে খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে৷

তা হলে দেখা যাচ্ছে, হাঁপানি রোগীরা মূল কষ্ট যেটা পান তার কারণ অসুখ নয়, অজ্ঞানতা৷ বলাই বাহুল্য, এ ব্যাপারে আমাদের অর্থাৎ, চিকিৎসকদের দায়িত্বই সব থেকে বেশি৷ অন্য নামে ডেকে লাভ নেই– গোলাপকে গোলাপ, কোদালকে কোদাল এবং হাঁপানিটা হাঁপানিই৷ রোগীরা বোঝেন না এ কথাটাও সত্য নয়৷ আমরা বোঝাতে পারি না বলাই ঠিক৷ রোগীরা কেন হাঁপানি ডায়াগনোসিস পছন্দ করেন না, সেটা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক৷ প্রথমত, কেউ লম্বা লড়াই পছন্দ করেন না৷ সে ডায়াবিটিস হোক আর হাঁপানিই হোক৷ দুই, হাঁপানিতে যে বংশানুর অবদান আছে এটা জানা সম্ভবত রোগীর মনে একটা অপ্রত্যক্ষ অপরাধবোধের জন্ম দেয় যে আমাদের সন্তানেরা এই অসুখটা পেয়েছে বা পেতে পারে৷

তিন, হাঁপানির চিকিৎসা এখনও কিছুটা বিতর্কিত৷ ইনহেলার শুনলেই লোকের ধারণা যে আসক্তি (addiction) তৈরি হয় এবং এক বার শুরু করলে আর ছাড়া যায় না৷ চার, ট্যাবলেট খাওয়া কাউকে শেখাতে হয় না৷ প্রাকৃতিক নিয়মেই একটি শিশুকেও লাল ট্যাবলেট দিলে সে মুখে পুরে দেবে৷ ইনহেলার স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ৷ কারণ প্রকৃতি চেয়েছে শ্বাসনালীকে স্বযত্নে বহিঃপ্রকৃতির প্রকোপ থেকে মুক্ত রাখতে৷ আর আমরা শেখাচ্ছি ঠিক তার উল্টো– ওষুধটাকে শ্বাসনালীর গভীরে প্রবেশ করিয়ে দিতে৷ এ বার এই সংশয়গুলোকে আমরা কীভাবে অতিক্রম করতে পারি? হাঁপানি মানেই ইনহেলার থেরাপি নয়৷ Knowledge is cure অর্থাৎ, শুধু সত্য জানলে এবং জীবনযাত্রা মানলে বেশিরভাগ সময় হাঁপানি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়৷

শ্বাসনালী খুঁতখুঁতে? বেশ তো– তা হলে আগে সেদিকেই নজর দেওয়া যাক৷ যে সমস্ত বস্তুতে সে রেগে ওঠে, সেই সব ধুলো, ধোঁয়া, তামাক যথাসম্ভব বর্জন করুন৷ বাইরের ধুলোর থেকে ঘরের ধুলো অনেক বেশি ক্ষতিকর৷ সেই সঙ্গে আছে dermatophyte নামে অসংখ্য কীট যা আপনারই বিছানায় জন্মায়, বড় হয়, বংশবৃদ্ধি করে এবং মারা যায়৷ আর সব সময় আপনার অ্যালার্জিকে বাড়িয়ে তোলে৷ বিছানার চাদর ও বালিশের ওয়াড় সপ্তাহে অন্তত একদিন ফুটন্ত জলে কাচুন৷ (গরম জল বলিনি)৷ শোবার ঘরে অন্তত কার্পেট রাখবেন না৷ কুকুর, বিড়াল, পাখি বা বনসাই যেন অন্তত শোবার ঘরে না থাকে৷ একই রকম ভাবে তাপমাত্রার তারতম্যও সামলান– বাইরের খুব গরম থেকে ঘরের বা অফিসের ভিতরে Chilled air conditioner-এ ঘন ঘন যাতায়াত বন্ধ করুন৷ খাওয়ার অব্যবহিত পরেই শুতে যাবেন না৷ অন্তত এক ঘণ্টা অপেক্ষা করুন নইলে কিছু খাদ্যকণা শ্বাসনালীতে গিয়ে উত্তেজক হিসেবে কাজ করতে পারে৷

শুধু এটুকু মানলে ৫০ শতাংশ রোগের উপশম করা যায়৷ আর পাথর গড়ানোর আগেই বন্ধ করা গেলে আরও ভালো৷ হাঁপানি অসুখ প্রকাশ পাওয়ার আগেই যদি এই নিয়মগুলি মেনে চলা যায় তা হলে হয়তো কোনও দিনই রোগটা দেখা দেবে না৷ এ তো ডিমের আগে মুরগির গল্প– যাঁর অসুখ নেই (অর্থাৎ, অসুখের লক্ষণ নেই) তিনি সাবধান হবেন কীভাবে? কেন, যাঁর বাড়ির লোকের হাঁপানি আছে– ভাই, বোন, মা বা বাবার, তাঁরাই সাবধান হতে পারেন৷ দেখা যাচ্ছে, বংশানু নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই৷ পরিবেশ নিয়ে সচেতন হওয়াটাই বুদ্ধির কাজ৷ অজস্র রোগ ও ক্যানসারের ক্ষেত্রেও বংশানুর ভূমিকা আছে– নিজেকে দোষী ভাবার কোনও কারণ নেই৷



মন্তব্য চালু নেই