বাংলাদেশ ছাড়ার ঘটনাও ঘটেনি

বিদেশিরা সতর্ক আতঙ্কিত নয়

পণ্য পরীক্ষার একটি বৈশ্বিক কম্পানির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার ঢাকায় আসার কথা ছিল গত সোমবার রাতে। কিন্তু বাংলাদেশে দুই বিদেশি নাগরিক খুনের ঘটনায় তিনি আসতে অনীহা জানান। এরপর বাংলাদেশ শাখা থেকে তাঁকে অভয় দেন কম্পানিটির প্রধান, যিনি নিজেও ভিনদেশি। এরপর ওই কর্মকর্তা গত সোমবার রাত ১২টায় ঢাকায় এসেছেন। তাঁকে বিমানবন্দর থেকে সামনে-পেছনে দুই গাড়ির ‘এসকর্ট’ দিয়ে ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন দিন কম্পানির নিরীক্ষা কাজ শেষে তিনি আবার সিঙ্গাপুর ফিরে যাবেন।

ওই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দুই বিদেশিকে হত্যা ও আইসের দায় স্বীকারের খবর বিশ্বে পৌঁছে গেছে। তবে আমরা তাঁকে বলেছি, এটা বাংলাদেশের আসল চিত্র নয়। তিনি আশ্বস্ত হয়ে এসেছেন।

দুই বিদেশি হত্যার ঘটনার পর এ দেশে অবস্থানরত সোয়া দুই লাখ বিদেশি নাগরিক আগের চেয়ে সতর্কতা অবলম্বন করছে। তাদের একা একা হাঁটা, সাইকেল চালানো, ক্লাবে যাওয়া আপাতত বন্ধ আছে। কিন্তু আতঙ্কে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া বা ভয়ে রাস্তায় বের না হওয়ার ঘটনা ঘটছে না। তাদের কেউ নিরাপত্তা চেয়ে দূতাবাসের দারস্থ হয়েছে- এমন খবরও পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিদেশি সহায়তা সংস্থা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশি এনজিও ও দূতাবাসগুলো তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশে বেশি সময় ধরে আছে- এমন ব্যক্তিদের বেশির ভাগই খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়। তবে যারা নতুন এসেছে, তারা কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করছে সহকর্মীদের কাছে। বাংলাদেশে যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী আছে, তারাও স্বাভাবিকভাবে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। আর কোনো দেশই বাংলাদেশ সফরে তার নাগরিকদের নিষেধ করেনি।’

গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট বলেন, তাঁর দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে আসতে নিষেধ করা হয়নি বা ছেড়ে যেতেও বলা হয়নি। বরং বাংলাদেশে অবস্থানের সময় সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, কর্ম এলাকায় নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাঁর দায়িত্বের অংশ। হামলার ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর দূতাবাস থেকে নাগরিকদের সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যখন মনে হবে যে ঝুঁকি দূর হয়েছে তখন পরামর্শ বদলানো হবে।

বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ সময়েও তাদের কর্মীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে তা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়। এটা রুটিন কাজ। বিভিন্ন দূতাবাসের ওয়েবসাইটেও নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ থাকে।

বাংলাদেশে বিদেশিদের কিছু সফর পেছানো হয়েছে। কয়েকটি সংস্থা আপাতত তাদের কর্মীদের ঢাকার বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। তবে তারা বলেছে, এটা সাময়িক। শিগগির সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মানতে গিয়ে এসব ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

গতকাল ও গত সোমবার কয়েকটি পশ্চিমা দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও, বহুজাতিক কম্পানি ও বিদেশি নাগরিক কর্মরত আছে এমন দেশি প্রতিষ্ঠানে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়া হয়। জানতে চাওয়া হয় তাদের বিদেশি কর্মীরা চলাচল সীমিত করেছে কি না, কেউ বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চেয়েছে কি না, প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের কী ধরনের নিরাপত্তা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, তারা বিদেশিদের সতর্কভাবে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছে। কেউ বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। তবে ওইসব প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে বা নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘আমরা সতর্কতা অবলম্বন করছি। তবে কাজ থেমে নেই। দুই বিদেশি হত্যার ঘটনায় আমাদের ধাক্কা লেগেছে। তবে উন্নয়ন কর্মীরা আরো কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশে তিন-চারজন বিদেশি আছেন। তাঁদের কেউ বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চাননি বলে জানান ফারাহ কবির।

একটি দাতা সংস্থার একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যারা সকালে বা সন্ধ্যায় সাইকেল চালাত, তারা এখন সেটি করছে না। যারা হাটত, তারা আপাতত তা বন্ধ রেখেছে। সতর্কতার ধরন এ রকম। এর বাইরে বিশেষ কোনো আতঙ্ক নেই। ওই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে বেশির ভাগই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছে। একটি খনিজ উত্তোলনকারী কম্পানির একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে বাড়তি কোনো নিরাপত্তার আয়োজন বা পরামর্শ দেওয়া হয়নি।

বেছে বেছে বিদেশিদের হত্যা করা দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়মিত ঘটনা। সেখান স্থানীয় অধিবাসীদের একাংশ চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় বিদেশিদের হত্যা করছে সেই ১৯৯৪ সাল থেকে। গত এপ্রিলেও এক হামলায় সাতজন বিদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। তার পরও দক্ষিণ আফ্রিকার শহরগুলোয় বিদেশিদের চলাফেরার দৃশ্য বিরল নয়। সেখানে ইউরোপ-আমেরিকার বহুজাতিক কম্পানিগুলোর ব্যবসা করতেও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

পাকিস্তানে শহরের কেন্দ্রে বোমা হামলার ঘটনা নিয়মিত। ভারতেও বিদেশি নাগরিককে ধর্ষণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তার পরও ওইসব দেশে পেশার প্রয়োজনে, ব্যবসার খাতিরে অথবা ঘুরতে যাচ্ছে অনেকে। দুই বিদেশি হত্যার পর পোশাক খাতে বায়ার্স ফোরামের বৈঠক স্থগিত ও কয়েকটি দেশের ক্রেতা প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফর স্থগিত করার ঘটনা ঘটেছে। তবে বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, এখনো অনেক বিদেশি বাংলাদেশে আছে। তারা পোশাকের কার্যাদেশ দিচ্ছে। অনেকে বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা বা বায়িং হাউজেও কাজ করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশিরা খুবই অতিথিপরায়ণ। তারা বিদেশিদের ভালোবাসে ও সন্মান করে। বাংলাদেশে বিদেশিদের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা অতীতে ঘটেনি। বিদেশিদের জন্য বাংলাদেশ অনিরাপদ নয়।

ফারুক হাসান বলেন, ‘প্রতিদিনই আমার সঙ্গে অনেক বিদেশির কথা হচ্ছে। তাঁরা বাংলাদেশে থাকতে মোটেও ভীত নন। আমরা দেখছি, দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তারাও বিশেষ কোনো নিরাপত্তার আয়োজন ছাড়াই চলাফেরা করছেন।’

যে অস্ট্রেলিয়া নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছে তারই পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য দপ্তরের হালনাগাদ ভ্রমণ পরামর্শে অস্ট্রেলীয়দের বাংলাদেশে আসতে নিষেধ করেনি। অস্ট্রেলিয়া তার নাগরিকদের বাংলাদেশের বিষয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ‘এক্সারসাইজ আ হাই ডিগ্রি অব কশান’ বা উচ্চমাত্রার সাবধানতা অবলম্বন করার যে পরামর্শ দিয়েছে, তা ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় ‘ভ্রমণ করবেন না’ ও ‘ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা পুনর্বিবেচনা করুন’ পরামর্শের চেয়ে কম। অস্ট্রেলিয়ার এমন পরামর্শ বলবৎ আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ বিশ্বের অন্তত ৫৯টি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৯টি দেশের বিষয়ে ‘ট্রাভেল ওয়ার্নিং’ এবং ছয়টি দেশের বিষয়ে ‘ট্রাভেল অ্যালার্ট’ রয়েছে। এর কোনোটিতেই বাংলাদেশের নাম নেই।



মন্তব্য চালু নেই