বিভিন্ন স্থানে সেনা ও বিহারিদের সঙ্গে বাঙালির তুমুল সংঘর্ষ

একাত্তরের ২০ মার্চ ছিল ঘটনাবহুল উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন। আন্দোলনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। এবারের সংগ্রাম প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামে।

আবালবৃদ্ধবনিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ, সারা বিশ্বের স্বাধীন জাতি কীভাবে স্বীয় লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’

এদিনই বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি দিয়ে ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপলক্ষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এদিন বিহারী ও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালীর তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে। আহত হয় অর্ধশতাধিক।

সারাদেশে এক উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। ক্ষুব্ধ বাঙালীরা পথে নেমে আসে। যুদ্ধেও প্রস্তুতি চলতে থাকে দেশজুড়ে। কিন্তু তখনো পূর্ব পাকিস্তানবাসী বুঝতে পারেনি যে অতর্কিতেই তাদের ওপর চালানো হবে অপারেশন সার্চ লাইট।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান এদিন তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতির পূর্ণ রূপ দেন। ওদিকে প্রতিদিনই ৬ থেকে ১৭টি পর্যন্ত ফ্লাইটে পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও যুদ্ধের রসদ নিয়ে আনা হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। স্থল ও বিমান শক্তি দ্বিগুণ করে।

১৯৭১-এর এই দিনটি ছিল শনিবার। লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিবস অতিবাহিত হয়। এদিন রাজধানীর সব সরকারি-বেসরকারি বাসভবন এবং যানবাহনসমূহে কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল।

যে সব অফিস খোলা রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশ দিয়েছিলেন সেগুলো ছাড়া আর সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বর্জন কর্মসূচি শান্তি ও সুশৃঙ্খলভাবে পালিত হয়।

স্বাধীনতার দাবি এবং বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগের সমর্থনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগানে রাজধানীসহ সারাদেশের রাজপথ আগের মতোই প্রকম্পিত থাকে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এবারের আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দলীয় ৬ জন শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী ছিলেন। তারা হচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং ড. কামাল হোসেন।

পক্ষান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সহকর্মী ৩ জন ছিলেন যথাক্রমে বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। আজকের আলোচনা প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সমগ্র পাকিস্তানসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও সংবাদ মাধ্যমসমূহের দৃষ্টি এ আলোচনার প্রতি নিবদ্ধ ছিল। দেশবাসীও অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল।

গতকালের জয়দেবপুরের ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিপুলসংখ্যক জনসমাবেশ ঘটে।

আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন হতে বঙ্গবন্ধু বের হয়ে এলে সংগ্রামী জনতা ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি স্লোগানে নেতাকে স্বাগত জানায়। পরে ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের আলোচনা অব্যাহত আছে। আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আগামীকাল পুনরায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসব। ইতোমধ্যে আমার উপদেষ্টাগণ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে সময় ঠিক করে মিলিত হবেন।’

আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট কি না এরূপ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে আমার এ মন্তব্য হতেই আপনাদের বুঝে নিতে হবে।’

কতদিন এ আলোচনা চলবে প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আলোচনা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না।’ এ সময় নেতাকে অত্যন্ত গম্ভীর ও প্রশান্ত দেখাচ্ছিল।

প্রতিদিনের মতো আজও রাজধানীর বিভিন্ন স্থান হতে বিপুল জনতা শোভাযাত্রা সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হয়। প্রতিটি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে একের পর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার জনগণের সার্বিক মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সত্যাগ্রহ চলবে। আন্দোলনে ভাটা পড়তে দেবেন না। সংগ্রামে শৈথিল্য আসলে শত্রুপক্ষই শক্তিশালী হবে। আমার আর কিছুই পাওয়ার নেই, যা আমি পেয়েছি এর কোন তুলনা নেই। বাংলার মানুষের এই বিশ্বাস ভালবাসা নিয়েই আমি মরতে চাই। আর তার আগে বাংলার মানুষের মুক্তি চাই। যত বাধাই আসুক এই লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশকে কলোনি করে বাজার করে রাখার দিন বাসি হয়ে গেছে। মুক্তিপিপাসু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই প্রতিহত করতে পারবে না।’

মিছিলকারীদের মধ্যে ছিল ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের কর্মচারী, ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মচারী, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, প্রাদেশিক সরকারের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও সেটেলমেন্ট কর্মচারীদের সংগঠনসমূহ।

অসাধারণ প্রাণশক্তি আর অদম্য মনোবল নিয়ে জনতার সংগ্রামী মিছিলের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু তার অগ্নিঝরা বক্তব্য প্রদান করছিলেন। সারাদেশের মানুষ অপূর্ব নিষ্ঠায় নেতার নির্দেশ প্রতিপালন করছে।

যদিও চতুর্থ দফা বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা আরো হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় বসাটা ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো, প্রহসন মাত্র। আলোচনার আড়ালে পাকিস্তানে স্বৈরশাসকরা বাঙালীদের স্বাধীনতার সমস্ত আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার কৌশলে ব্যস্ত ছিল।

এরই মধ্যে পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা নির্বাচনে বাঙালী নিধনে অপারেশন সার্চ লাইটের সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলে। এদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হামিদ ও জেনারেল টিক্কা খানের এক বৈঠক থেকেই অপরাশেন সার্চ লাইটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।

একাত্তরের এই দিনে ছাত্র ইউনিয়ন এক ভিন্ন রকমের কর্মসূচি পালন করে। তাদের উদ্যোগে গঠিত গণবাহিনী ১০ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ করে রাজপথে এক শোভাযাত্রা বের করে। এতে প্রতিটি সদস্য সেদিন ডামি রাইফেল নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী)। তার নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা বের হয়। সে সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও (বর্তমানে সিপিবি সভাপতি) সর্বক্ষণিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে ও ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।



মন্তব্য চালু নেই