বিমানবন্দরে রোমহর্ষক যাত্রী হয়রানি: ফ্লাই দুবাইয়ের চার কর্মকর্তাকে জরিমানা

রোমহর্ষক যাত্রী হয়রানি ও কল্পনাতীত প্রতারণার দায়ে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হয়েছে ফ্লাই দুবাই’কে। গত বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মোবাইল কোর্ট এ জরিমানার আদেশ দেন এয়ারলাইন্সটির স্টেশন ম্যানেজারসহ দায়ী চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

ঘটনার সূত্রপাত

গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে বিমানবন্দরে ওই সময় কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফের কাছে খবর আসে, ফ্লাইদুবাই’র ওভাবুকিং এর কারণে ফ্লাইটে আসন গ্রহণ করা অবস্থা থেকে অল্পবয়সী এক যাত্রীকে প্লেন থেকে অফলোড করায় ওভারশকড হয়ে ডির্পাচার লাউঞ্জে হাউমাউ করে কাঁদছেন। খবর পেয়ে তিনি ছুটে গিয়ে দেখেন যাত্রী লাপাত্তা!

মূল স্টেশন ম্যানেজারের কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারেন তাঁর আজ ডেঅফ, তবে যাত্রী তাদের তত্ত্বাবধানে উত্তরার একটি হোটেলে আছেন। অন্যদিকে, দায়িত্বে থাকা স্টেশন-ইনচার্জ’কে ফোন দিলে তিনি জানান যাত্রী ফার্মগেটে আত্মীয়ের বাসায় চলে গেছেন। একজন অল্পবয়স্ক ওভারশকড মিসহ্যান্ডেল্ড গ্রামের যাত্রীর ক্ষেত্রে এরূপ বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাৎক্ষণিকভাবে শিফটের স্টেশন-ইনচার্জ মাসুম কে গ্রেপ্তার করে যাত্রীকে কোর্টে হাজির না করা পর্যন্ত কোর্ট হেফাজতে আটক রাখার নির্দেশ দেন।

বিশ ঘণ্টার মোবাইল কোর্ট

রাত দশটায় যাত্রীকে হাজির করা হলে তার অভিযোগ ভোক্তা অধিকার সংক্ষণ আইনের ৫৩ ধারায় আমলে নিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বিচার শুরু করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ। ডাকা হয় এয়ারলাইন্সটির সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাকে। রাত পেরিয়ে পরদিন সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অবিরাম বিশ ঘণ্টাব্যাপী পরিচালিত এই মোবাইল কোর্টে একের পর এক বেরিয়ে আসে অবিশ্বাস্য যত তথ্য।

অমানবিক হয়রানি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার বাসিন্দা বিশবছর বয়সী যাত্রী ইব্রাহিম প্রথমবারের মতো এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় ফ্লাইদুবাই’র টিকেট কেটে যাচ্ছিলেন ওমানের সালালাহ শহরে। সব ফরমালিটিজ সেরে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে এগারোটায় এফজেড-৫৮৪ ফ্লাইটে চড়ে পাশের সিটে বসা চাচাতো ভাইয়ের সাথে প্রথম প্লেনে চড়া, স্বপ্নের বিদেশযাত্রার উত্তেজনার অনুভূতি প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন দরিদ্র ইব্রাহীম।

বিমান হাঁটা শুরু করল। কয়েক মিনিট পর ব্রেক। হাসান নামের এক যাত্রী তিন নম্বর বাসের মতো দাড়িয়ে আছেন, সিট খালি নেই! পাইলট মাথা গুনে দেখলেন ধারণ ক্ষমতা ১৮৯ হলেও যাত্রী ১৯০ জন। ইমার্জেন্সি কলে এক অফিসার বিমানের ভেতরে গিয়ে ইব্রাহীমের পাসপোট-বোর্ডিংপাস চেক করে বলেন, ‘সমস্যা আছে, যাওয়া যাবেনা।’ হতভম্ব ইব্রাহীমকে বিমান থেকে বের করার সময় তার চাচাতো ভাই কারণ জানতে চাইলে তাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়।

বিমানের পাশে মাঠে রাখা একটি মাইক্রোতে তাকে বসিয়ে রেখে অফিসার চলে যান। একা মাইক্রোতে বসে বসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানটির দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। প্রায় এক-ঘণ্টা পর বিমানটি চলে গেলে অন্য এক অফিসার গিয়ে ইব্রাহীমকে নিয়ে এসে ডিপার্চার লাউঞ্জে বসিয়ে রেখে চলে যান। সান্তনা তো দূরের কথা, কেন তার যাওয়া হবেনা, আদৌ যেতে পারবে কিনা, এ ধরণের একটি প্রশ্নেরও জবাব দেন নি তিনি।

বিকাল চারটা পর্যন্ত ওই অবস্থায় ফোঁপাতে থাকেন ইব্রাহিম। পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া ফ্লাই দুবাই’র এক অফিসারকে ড্রেস দেখে চিনতে পারেন। সামনে গিয়ে বলেন, ‘সার, আমার কি হবে?’ অত্যন্ত বিমর্ষ ইব্রাহীমকে রাফাত নামক সেই অফিসার গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘অবশ্যই যাবে, তোমাকে আজ রাত দশটার ফ্লাইটেই পাঠানো হবে।’ মুহূর্তের মধ্যেই সতেজ হয়ে ওঠেন ইব্রাহীম, ‘স্যার, খুব ক্ষুধা লাগছে! আব্বু আম্মু বাইরে আছে, আব্বুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিছু খাবো, আমারে একটু বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।’

রাফাত সাহেব উর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে ইব্রাহীমকে লাউঞ্জের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাবার অর্ডার দিয়ে চলে যান। খাওয়া শেষে ইব্রাহীম আবার লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে থাকেন। রাত পৌনে আটটার দিকে দু’জন অফিসার এসে জানায়, রাতের ফ্লাইটেও পাঠানো যাচ্ছে না তাকে, পরদিন রাতের ফ্লাইটে যেতে হবে। ইমিগ্রেশন-সিল ক্যান্সেল করে বাইরে নিয়ে যাবে শুনেই অবিশ্বাস ও আতঙ্কে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন ইব্রাহীম।

ডিউটিরত একাধিক সংস্থার অফিসার এগিয়ে গিয়ে ইব্রাহীমকে ঐ রাতের ফ্লাইটে না পাঠাতে পারার কারণ জানতে চাইলে এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা জানান, সেই ফ্লাইটে পাঠালে দুবাই থেকে সালালাহর কানেক্টিং ফ্লাইট ২৪ ঘণ্টারও বেশি হয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টার বেশি ট্রানজিট ইমিগ্রেশন এলাউ করবেনা। প্রতিউত্তরে, দুবাই থেকে সালালাহ অংশে ফ্লাইদুবাই ছাড়া অন্য এয়ারলাইন্সের টিকেটে ইব্রাহীমকে পাঠানোর অনুরোধও রাখেননি এয়ারলাইন্স অফিসাররা।

সংস্থাগুলোর মাধ্যমে খবর পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে যেতে যেতেই ইব্রাহীমের ইমিগ্রেশন-সিল ক্যান্সেল করিয়ে বাইরে নিয়ে তাঁকে হোটেলে নিয়ে যেতে চাইলে ইব্রাহীম রাজী হননি। চলে যান নাখালপাড়া ফুফুর বাসায়।

রোমহর্ষক প্রতারণা

এয়ারলাইন্সটির সিস্টেম থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, নির্ধারিত এফজেড-৫৮৪ ফ্লাইটের ধারণক্ষমতা ১৮৯। বুকড প্যাসেঞ্জার সংখ্যা ১৯৮। উপস্থিত প্যাসেঞ্জার ১৯১। ধারণক্ষমতা অনুযায়ী চেকড-ইন হয়েছে ১৮৯ জন। উপস্থিত অতিরিক্ত ২ জনের একজনকে বোর্ডিং ডিনাই করে পরবর্তী ফ্লাইটের আশ্বাসে হোটেলে পাঠানো হয়েছে, বাকি জন? বিমান রানওয়ের কাছাকাছি যাবার পর আরেকজনের চিৎকার, ‘ও ভাই, আমার সিট গেল কই?!

কাউন্টারে চেক-ইন করার সময় সিস্টেমে যাত্রী হাসানের এন্ট্রি দিয়ে বোর্ডিং পাশ ইস্যুর পর ইব্রাহীমের পালা। ইব্রাহীমের এন্ট্রি না দিয়েই হাসানের ডুপ্লিকেট বোর্ডিং পাস দিয়ে দেয়া হলো ইব্রাহীমকে। বোর্ডিং গেইটে আইএনএস চেকিংয়েও ধরা পড়লোনা এ ভুল (!)

চেক-ইন এন্ট্রি না থাকায় ইব্রাহীমকে নামানো হলেও নামানো হয়নি তার বুকিং ব্যাগ। আইকাও’র বিধানমতে নিরাপত্তাজনিত কারণে প্যাসেঞ্জার ছাড়া কখনও ব্যাগ নেওয়া যাবে না। প্যাসেঞ্জারের সাথে ব্যাগ যাবে। কোনও কারণে প্যাসেঞ্জারের সাথে ব্যাগ না নিতে পারলে পরে ব্যাগ যেতে পারে, কিন্তু কখনও আগে ব্যাগ যাবেনা। অথচ এক্ষেত্রে এরকম একটা কনফিউজিং পরিস্থিতিতে ঘটলো তার উল্টো। যদিও পরে হাস্যকরভাবে জানা গেল, ইব্রাহীমের ব্যাগ অফলোড না করে অফলোড করা হয়েছে তার চাচাতা ভাইয়ের ব্যাগ।

আরও মজার বিষয় হলো গত পাঁচ বছর ধরে এখানকার ফ্লাই দুবাই কর্তৃপক্ষ বলে আসছে তাদের ওভারবুকিং এর কারণে প্যাসেঞ্জারের বোর্ডিং ডিনাই করা হলে পরবর্তী থাকা-খাওয়াসহ গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকলেও ডিনাইড বোর্ডিং কমপেনসেশন (ডিবিসি) এর পলিসি নেই। অথচ মোবাইল কোর্টে উপস্থাপিত তাদের হাজার পৃষ্ঠার ম্যানুয়েল ঘেটে দেখা গেল, ফ্লাই দুবাই’র ডিবিসি পলিসি রয়েছে এবং তা হলো একটি ডিবিসি ভাউচার যেটা দিয়ে প্যাসেঞ্জার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে একই রুটে যে কোনও মুখে একটি ‘ওয়ান-ওয়ে’ টিকেট বিনামুল্যে পাবেন।

হিসেব করে দেখা যায় যে, ২০১১ সাল থেকে ১০১৬ সাল পর্যন্ত এয়ারলাইন্সটি কেবল ঢাকা স্টেশনেই ওভারবুকিং এর জন্য ২০৮০ জন প্যাসেঞ্জারকে ডিনাই করে কেবল থাকা-খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছে। একটি ডিবিসি ভাউচারও দেওয়া হয় নাই। ওয়ানওয়ে একটি টিকেটের ক্রয়মূল্য সময়ভেদে ১৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। সেই হিসেবে এ পর্যন্ত ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যগামী বাংলাদেশী এই ২০৮০ জন প্যাসেঞ্জারকে তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সত্য গোপন করে তিন থেকে নয় কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করেছে। ২০১০ সাল থেকে অপারেশন শুরু হওয়া চট্টগ্রাম স্টেশন হিসেবে নিলে এই অংক দ্বিগুণ হতে পারে।

সাজা

সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রতিশ্রুত সেবা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় ফ্লাই দুবাইয়ের স্টেশন ম্যানেজার সেলিম মোবাশশের উদ্দীনকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড, সিকিউরিটি ম্যানেজার গোলাম রাব্বিকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড, ট্রাফিক অফিসার ফেরদৌস আহমেদকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ট্রাফিক অফিসার আশিকুল ইসলামকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়।

পাশাপাশি, প্যাসেঞ্জারদের ন্যায্য অধিকার হিসেবে বর্ণিত অপরিশোধিত ডিবিসি ভাউচারের অর্থমূল্য ৩-৯ কোটি টাকা সিস্টেম থেকে ঐসব প্যাসেঞ্জারের তথ্য নিয়ে তাদের যথাসম্ভব পরিশোধের কিংবা ডিবিসি ভাউচার দেয়ার অনুরোধ করা হয় এবং ভবিষ্যতে যাতে একজন ওভারবুকিং-ডিনাইড প্যাসেঞ্জারও এ ক্ষতিপূরণ তথা ওয়ান-ওয়ে ফ্রি টিকেট ভাউচার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে যত্নবান হবারও নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

মোবাইলকোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জরিমানা তাৎক্ষণিকভাবে আদায় হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট আইনের বিধানমতে এর ২৫ শতাংশ তথা ১ লাখ ৬২ হাজার ৫ শ’ টাকা ভুক্তভোগী ইব্রাহীম ইতিমধ্যে তার বাবা-মাসহ (ছবি) এসে বুঝে নিয়েছেন এবং গতকাল রাত দশটার ফ্লাইটে ইব্রাহীম আগের টিকেটেই ওমানে গেছেন। পাশাপাশি ওভারবুকিং-ডিনাইড প্যাসেঞ্জার হিসেবে দু’বাই থেকে ডিবিসি ভাউচারও পেয়েছেন, যা তিনি পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ওয়ান-ওয়ে টিকেটে কনভার্ট করতে পারবেন।



মন্তব্য চালু নেই