বিশ্বে সর্বোচ্চ সেচ খরচ বাংলাদেশে

ভয়াবহ পানি সংকটের কবলে বাংলাদেশ। নদ-নদীতে পানি নেই। চৈত্রের দাবদাহে এরই মধ্যে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একদিকে কমছে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ক্রমেই নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। অনেক অঞ্চলে গভীর নলকূপেও ঠিকমতো উঠছে না পানি। চলতি বোরো মৌসুমে সেচ প্রকল্পগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সবচেয়ে দুরবস্থা তিস্তা সেচ প্রকল্পের। পানির দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচ খরচ। বিগত ১০ বছরে বোরো সেচে কৃষকের খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

এ রকম প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘পানি ও কর্মসংস্থান’।

ইউনিসেফ হুঁশিয়ার করেছে, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিরাপদ পানির সংকটে পড়বে কয়েক কোটি মানুষ। বিশেষ করে বন্যা ও খরাপ্রবণ এলাকার কয়েক কোটি শিশু পানি সরবরাহ ও নিরাপদ পানি সংকটের মুখোমুখি হবে।

সেচ সংকটের মধ্য দিয়েই সারাদেশে শুরু হয়েছে বোরো মৌসুম। বিএডিসির হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় চার লাখেরও বেশি অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ৪৮ জেলার ২১৩ উপজেলায় দেখা দিয়েছে পানির তীব্র সংকট।

বিএডিসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল কার্যকর রয়েছে। এসব টিউবওয়েল ২২ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকে পানি ওঠায়। কিন্তু এখন মাটির ২৪ ফুট নিচে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কৃষক পাঁচ ফুট মাটি গর্ত করে সেখানে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছে। এর পরও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে কৃষকের সেচ খরচ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর এ খরচ বিশ্বে সর্বোচ্চ। এ দেশের কৃষক সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬২ শতাংশ অর্থ খরচ করে থাকেন। সেচ খরচে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। তারা সেচের জন্য ২৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনাম সেচের পেছনে খরচ করে মাত্র ১৩ শতাংশ।

বিএডিসির বাংলাদেশ ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক দশক আগেও প্রতি হেক্টরে বোরো আবাদে সেচের খরচ ছিল চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু গত মৌসুমে তা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জ্বালানি খরচসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যয় স্থির থাকলে ২০২০ সালে তা ২০ হাজার ছাড়াবে। উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলায় ১৯৮১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তাও দেখিয়েছে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীতে এ সময়ে পানির স্তর ৫ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। সবচেয়ে বেশি নেমেছে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়। আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যত নিচে নেমে যাবে, বোরোর উৎপাদন খরচ ততই বাড়বে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক কেজি বোরো ধান উৎপাদন করতে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার লিটার পানি লাগে। এই পানি মাটির গভীর থেকে ওঠাতে প্রতি বিঘার জন্য প্রায় এক হাজার পাঁচশ’ টাকা সেচযন্ত্র মালিকের খরচ হয়। কৃষকের খরচ হয় ২৮ ভাগ অর্থাৎ বিঘায় চার থেকে পাঁচ মণ ধান। কিন্তু প্রতি বছর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সেচের খরচ বাড়ছে। এতে ব্যবহার করতে হয় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বা ডিজেলের। ফলে প্রতি হেক্টরে সেচ বাবদ কৃষকের শতকরা ১৫-২০ শতাংশ খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের সেচ বিশেষজ্ঞ ড. ইফতেখারুল আলম বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে, বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা; সে সঙ্গে পানির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে চার হাজার লিটার পানিতে এক কেজি ধান উৎপাদন হয়। আগে সেটা হতো সাড়ে তিন হাজার লিটারে। অথচ চীনে এক কেজি ধান উৎপাদন হয় এক হাজার লিটার পানিতে।

এ বিষয়ে কৃষি, পানি ও পরিবেশ প্রকৌশলী এবং বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক ড. ইফতেখারুল আলম বলেন, যত্রতত্র পানি ব্যবহারের ফলে কৃষকের সেচ খরচ বাড়ছে। পানিকেন্দ্রিক প্রকল্পের অভাবে দেশে পানির অপচয় হচ্ছে। টেকসই পরিকল্পনা ছাড়া পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ভূ-উপরিস্তরের পানির ব্যবহার না বাড়লে এবং বৃষ্টির পানি ধরে না রাখতে পারলে আগামীতে ভয়াবহ সেচ সংকটের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

৩০ বছর ধরে পানি নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃষ্টির পরিমাণ হ্রাস, নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে সেচের পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে।সমকাল



মন্তব্য চালু নেই