বিসিবি’র কঠোর সমালোচনায় সাবেক অধিনায়ক বুলবুল

মাঈনুল ইসলাম নাসিম : বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের চলমান সাফল্য ধরে রাখতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)’র তেমন কোন বিশেষ পরিকল্পনা না থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। একইসাথে সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক নিয়মে বিসিবি পরিচালিত না হওয়ায় বোর্ডের কঠোর সমলোচনা করেছেন স্বনামধন্য সাবেক এই খ্যাতিমান অধিনায়ক। বাংলাদেশের বাইরে আমিনুল ইসলাম বুলবুল বর্তমানে কর্মরত আছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)’র গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি খোলামেলা কথা বলেন প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থে যা যা করণীয় তা নিয়ে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রশিক্ষক হিসেবে আমিনুল ইসলাম বুলবুল পেশাগত কারনে প্রবাসে আছেন প্রায় ১ যুগ ধরে। বর্তমানে মেলবোর্নে বসবাসের সুবাদে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াস্থ আইসিসি’র অফিসে বসেন। অনলাইন ওয়ার্কের পাশাপাশি ক্রিকেট দুনিয়ায় বছরজুড়ে ঘুরে বেড়াতে হয় কাজের প্রয়োজনে। এর আগে ৮ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি)’র সাথে ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে। দেশে দেশে কী করছেন বাংলাদেশের একসময়ের রত্ন-ক্রিকেটার বুলবুল, জানতে চাওয়া হয় তাঁর কাছে। বললেন, “আমার মেইন কাজ হচ্ছে চায়নাকে ক্রিকেটে নিয়ে আসা। হংকং ও সিঙ্গাপুরকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পাশাপাশি মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলো যাতে বিশ্ব ক্রিকেটে উঠে আসে, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত”।

“বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে, ভালো লাগছে দেখতে। আমরা যখন শুরু করেছিলাম, আমাদের আগে রকিবুল ভাই, বাদশাহ ভাই, আশরাফুল ভাই, হীরা ভাইরা খেলতেন, তারপর লিপু ভাইয়েরা আসলো, সবাই একটা জায়গায় নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। আমরা ভাগ্যবান ছিলাম কারন আমাদের সময় বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ওয়ানডে স্টেটাস পেয়েছে, টেস্ট স্টেটাস পেয়েছে, সবকিছু একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু একইসাথে আজ খারাপ লাগে যখন দেখি যে, সম্ভাবনাময় একটা দেশে যেখানে ক্রিকেট এতো পপুলার, সেখানে সংবাদ মাধ্যমের কল্যানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খেলার নিউজটা পৌঁছে গেলেও ক্রিকেট নিয়ে এখনো পৌঁছাতে পারিনি আমরা। জেলা ভিত্তিক এবং বিভাগীয় ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাতে পারিনি আমরা। উপজেলায় কোন ক্রিকেট নেই। স্কুল ক্রিকেট যাচ্ছেতাই ভাবে হচ্ছে”।

আক্ষেপ আর ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলের কথায়। “একটা বিশাল সম্ভাবনাময় এই খেলাটা আমরা ঢেলে সাজাতে পারছি না দেশব্যাপী। যে উন্মাদনাটা আছে ক্রিকেটে, শুধু সেটা নিয়েই আমরা বসে আছি। আসলে বাংলাদেশের ওভারঅল সিস্টেমটাই ঠিক নেই। যে প্রক্রিয়ায় বোর্ড ডিরেক্টর হয়, যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেট চলছে এখন, সেটা কিন্তু ঠিক না। আপনি দেখবেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে এখন যে ২৫ জন ডিরেক্টর আছেন, তাদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বা ক্রিকেট সম্পৃক্ত তথা ক্রিকেটীয় লোক কিন্তু খুব একটা নেই। যদিও যে ক’জন সাবেক ক্রিকেটার আছেন, তাদের কতটুকু কীভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে সেটাও দেখার ব্যাপার। এখানে আমি কৃতিত্ব দেবো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা ক্রিকেটকে ভালোবাসে, ক্রিকেটকে সাপোর্ট করে যাচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে”।

আমিনুল ইসলাম বুলবুল আরো জানান, “একসময় বাংলাদেশে কিন্তু প্রত্যেকটা জেলায় জমজমাট লীগ হতো, এখন কিন্তু সেগুলো কিছু হয় না। একসময় আমরা চিটাগংয়ে দেখতাম স্টার সামার হতো এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলাতে বড় বড় টুর্নামেন্ট হতো, এখন সেগুলো হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেট মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এতো দুরবস্থার মধ্যেই যেসব নতুন ক্রিকেটাররা উঠে আসছে, তারা অটোম্যাটিক্যালি আসছে। আইপিএল কিন্তু ক্রিকেটের উন্নয়নে কোন কাজ করছে না। এটা সাহায্য করছে পপুলারিটির জন্য। মূলত ‘মানি ওরিয়েন্টেড’ বিষয়গুলোকে ঘিরেই এই ধরনের প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে বিপিএল যদি আইপিএলকে ফলো করে এগিয়ে যায়, সেটা ঠিক হবে না। আমাদের উচিত নিজেদের স্ট্রাকচারটা ঠিক করা”।

“বাংলাদেশে এখন যে জাতীয় লীগ হয় চার দিনের টুর্নামেন্ট, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, মীরপুর স্টেডিয়াম থেকে টিম বানিয়ে যাবার পর সেই টিমটাই ধরেন বরিশাল টিম হয়ে যায় কিংবা খুলনা-রাজশাহী-চিটাগং টিম হয়ে যায়। কিন্তু চিটাগংয়ের লোকাল যে অনুর্ধ ১৯, অনুর্ধ ১৭ টিম থাকবে, তার নিজস্ব একটা বিভাগীয় ‘হেড টিম’ থাকবে, সেগুলো কিন্তু নেই। যার ফলে দেশব্যাপী ক্রিকেট যেভাবে হওয়ার কথা ছিলো সেটা হচ্ছে না, যেটা হচ্ছে তা শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রীক ক্রিকেট এবং সেটা দিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বিপিএল-এর দিকে আমরা বেশি মনযোগী না হয়ে আমাদের এই স্ট্রাকচারগুলি ঠিক করা উচিত আগে”।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বর্তমানে যেভাবে চলছে তার কঠোর সমালোচনা করে আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “একটা বোর্ড যখন নির্বাচিত বোর্ড হয় তখন কিন্তু তার কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকে, গঠনমূলক ব্যাপারগুলো থাকে। প্রত্যেকটা বোর্ডে একটা পলিসি থাকে। সেই পলিসির মধ্যে প্রত্যেক বছর ১ বার করে এজিএম হওয়ার কথা, প্রত্যেক ২ মাস অন্তর বা প্রত্যেক মাসে ১টা করে বোর্ড মিটিং হওয়ার কথা, যেখানে সকলে গণতান্ত্রিকভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করবে। আমি যদ্দুর জানি এই ক’বছরে ২-৩ টার বেশি মিটিংই হয়নি বা একটা বারও এজিএম হয়নি। একজন ক্রিকেট কোচ হিসেবে যদিও এই ব্যপারগুলোতে আমার নাক গলানো ঠিক না, তারপরও বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থে আমার কাছে মনে হয়, একটা সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক নিয়মে বোর্ডকে চালাবার জন্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া উচিত”।

পরফরম্যান্স দেখিয়ে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের মধ্যে একটা শক্তিশালী ক্রিকেট দল হিসেবে রুপান্তরিত হয়েছে বলে মনে করেন আইসিসি’র গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ যেভাবে ভালো খেলছে, এই খেলাটা ধরে রাখার জন্য একটা বিশাল পরিকল্পনা দরকার। এবার যখন আমরা বিশ্বকাপ থেকে ফিরে গেলাম ভালো খেলে, তখন আমাদের উচিত ছিলো বিভাগগুলোতে একটা বা দু’টো করে ইনডোর করে ফেলা। আমরা জানি যে, বর্ষাকালে আমরা ক্রিকেট খেলতে পারি না আবহাওয়ার কারনে। আমরা কথায় কথায় স্টেডিয়াম বানিয়ে ফেলি অথচ স্টেডিয়াম না বানিয়ে আমাদের খেলার মাঠ দরকার ছিলো। ছেলেরা যাতে ভালো উইকেটে ভালো আউটফিল্ডে খেলতে পারে সে ধরনের মাঠ দরকার, সেগুলো কিন্তু নেই আমাদের”।

“স্টেডিয়াম আছে বেশ কিছু, কিন্তু ১শ’ বা দেড়শ’ খেলার মাঠ যদি আমরা আবেদন করতাম সরকারের কাছে, তাহলে অবশ্যই আমরা সেটা পেয়ে যেতাম। আমাদের ভালো টার্ফ উইকেট নেই ঢাকার বাইরে, সেগুলো ডেভেলপ করা উচিত। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে যে, জাতীয় দলের সাফল্য ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাবার জন্য ‘সলিড ব্যাকআপ’ দরকার। ব্যাকআপটা যেটা হচ্ছে, আমাদের অনুর্ধ-১৯ টিম থেকে ভালো ভালো ক্রিকেটার উঠে আসছে, কিন্তু বস্তুতপক্ষে আমাদের দেশের যতো ক্রিকেটার আছে সবাইকে সে সুযোগটা আমরা দিতে পারছি না। উপজেলা পর্যায় থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে প্লেয়াররা যে সেন্ট্রালে আসবে, সেই ধরনের কোন ‘টপ-টু-বটম’ প্ল্যান নেই। ‘বটম-টু-টপ’ প্লেয়ার সাপ্লাইয়ের কোন সিস্টেম আমাদের নেই। এই জায়গাগুলিতে এখন সিরিয়াসলি কাজ করা উচিত”।

আমিনুল ইসলাম বুলবুল জানান, “একটা কনসেন্ট্রেটেড ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ। এখানে হাজার হাজার সম্ভাবনাময় ক্রিকেটাররা আছে। তাদের সবাইকে সুযোগ দেওয়া প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। শুধুমাত্র একজন মুস্তাফিজ, সৌম্য সরকার বা সাকিব নিয়ে আমরা হ্যাপি আছি, কিন্তু আমাদের দেশে বহু ট্যালেন্টেড ক্রিকেটার আছে। যদি আমরা তাদেরকে সুযোগ দিতে পারি, আমি ব্যক্তগতভাবে বিশ্বাস করি, যেহেতু এই খেলাটার সাথে আমি সারাজীবন জড়িয়ে আছি, আমরা যদি প্রপার সিস্টেমে এগিয়ে যেতে পারি, আমি নিশ্চিত আগামী দশ বছরের মধ্যে আমরা বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট দল হিসেবে পরিগনিত হতে পারবো। টি-টোয়েন্টি, ফিফটি-ফিফটি এবং টেস্ট ম্যাচ এই তিনটা ফরম্যাটে খেলা হয় এখন। আমাদের বিশেষ লক্ষ্য দিতে হবে এখন টেস্ট রেংকিংটা বাড়ানো এবং এতে করে অটোম্যাটিক্যালি অন্যান্য রেংকিংগুলি আমাদের এগিয়ে যাবে”।



মন্তব্য চালু নেই