“বিয়ে মানেই ধর্ষণের বৈধতা না”

সুমু হক : আজ সকালে একটা কার্টুন দেখে মনটা বিষিয়ে গেলো। একজন ভদ্রমহিলা একটা কার্টুন শেয়ার করেছেন “জাস্ট ফর ফান” টাইটেল দিয়ে, যার মূল বক্তব্য এরকম, “স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলন যদি ধর্ষণ হয়, তো স্বামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে শপিংকে নাকি তাহলে বলা উচিত ছিনতাই।”

বলা বাহুল্য এই পোস্টটির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে ভদ্রমহিলা পোস্টটি মুছে দিয়েছেন। আশা করছি যে সেটা তিনি তার শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে বলেই করেছেন, নেহায়েৎ চক্ষু লজ্জার কারণে নয়।

এই একটি পোস্ট না হয় মোছা গেলো, কিন্তু আমাদের সমাজের এমনকি তথাকথিত “শিক্ষিত” গোষ্ঠীর একটা বড় অংশের ভেতরেও যে এই মানসিকতা শেকড় গেড়ে রয়েছে, এবং সাময়িকভাবে আধুনিকতার চাকচিক্য সেটাকে ঢেকে রাখলেও, সুযোগ পেলেই যে এই ধরনের চিন্তাভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, আর দিনযাপনের প্রতিটি পর্যায়েও যে এই মানসিকতারই জয়জয়কার, তার কী হবে!

বৈবাহিক সম্পর্কের অন্তরালে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যাকে কিনা ইংরেজিতে ‘ম্যারিটাল রেপ’ বলে, সেটা অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। এর শিকার যারা হয়েছেন তারা এবং তাদের কাছের মানুষেরাই কেবল উপলব্ধি করতে পারেন এর ভয়াবহতা। এর ভয়াবহতা আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে, তার কারণ আমাদের সমাজ, ধর্ম এবং এমনকি আইন ব্যবস্থাও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একে বৈধতা দিয়ে এসেছে।

অনেক অনেক যুগের লড়াইয়ের পর খুব সম্প্রতি আমরা এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে চলেছি, এ বিষয়ে আইনত শাস্তির বিধানও তৈরি হয়েছে খুব বেশিদিন আগে নয়। তাই আজও যারা এই বিষয়টিকে নিছক তামাশার বিষয় বলেই গণ্য করছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, একবার কেবল ভাবুন, ঘরের বন্ধ দরজার আড়ালে দিনের পর দিন ধর্ষিত হতে থাকা সেই অসংখ্য নারীদের কথা, একবার ভাবুন, সেই ধর্ষণের ফলে এবং সেই নারকীয়তার মাঝে জন্ম নিয়ে এবং বেড়ে ওঠা সন্তানদের অসহনীয় অভিজ্ঞতার কথা। বাজি রেখে বলতে পারি, সত্যি সত্যি সে অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করতে পারলে কলমের কালি শুকিয়ে যাবে আপনার, কিংবা কিবোর্ডে রাখা আঙ্গুল অবশ হয়ে আসবে।

বাংলাদেশে এ বিষয়ে কতখানি গবেষণা হয়েছে কিংবা তথ্য উপাত্ত সংরক্ষিত হয়েছে সেটা আমার জানা নেই.. কিন্তু আমি কানাডার আইনের কথা বলতে পারি যে, এদেশের মতোন একটি উন্নত দেশেও ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ ছিল নিতান্তই একটি বিবাহ বহির্ভূত অপরাধ।

The Canadian Panel on Violence Against Women এর ১৯৯৩ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ৮১% ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের ভূমিকা নেয়া পুরুষটি ধর্ষণের শিকার নারীর পূর্ব পরিচিত, ৩৮% ক্ষেত্রে এই যৌন সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোর হোতা স্বামী, কমন -ল পার্টনার কিংবা প্রেমিকেরাই।

খোদ কানাডার মতো জায়গায় যেখানে পরিস্থিতি এইরকম, বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কথা ভাবলেও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

পরিসংখ্যান তো খুব শুকনো কাঠখোট্টা বিষয়, আসুন, এবার একটি গল্প বলি। আমাদের দেশেরই কোন এক মফস্বল শহরের সত্তরের দশকের শেষের দিককার গল্প।

একটি মেয়ে, ধরা যাক, তার নাম সামিয়া, সবাই যাকে সাধারণ বিচারে সুন্দরী বলে জানে, সেই হিসেবে বেশ সুন্দরীই বলতে হয় তাকে। লম্বা একহারা গড়ন, ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল, দুধে আলতায় গায়ের রং, কমলালেবুর কোয়ার মতন ঠোঁট। সর্বোপরি যা তৎকালীন বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বেশ নতুন ধরনের বিষয়, মেয়েটি উচ্চশিক্ষিত এবং একটি ভালো মাইনের চাকরিও করে। মেয়েটির বাবা সেই সময়ের সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে মেয়েকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার নিজের ভবিষ্যতের ভার এবং সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার সেই মেয়েটিকে দেবার মতো আধুনিক তখনও হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। তাই অবশেষে সেই কোরবানির গরু দেখতে আসার মতো করে তাকেও পাত্র দেখতে এলো এবং সামাজিক ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নামক অলৌকিক এবং অদেখা মূল্যে মেয়েটি বিয়ের হাটে বিক্রিও হয়ে গেলো।

বহুদিন পরে একবার তাকে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছিলাম, বিয়ের সময় নাকি সে কবুল পর্যন্তও বলেনি নিজ মুখে।

“তাহলে তো সে বিয়েটাই অবৈধ!” আমার এ প্রশ্নের উত্তরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না তার। বোধ করি এতোদূর তলিয়ে দেখবার মতো সাহস কখনো হয়নি তার!

দক্ষিণ এশীয় সমাজ ব্যবস্থায় যেমন হয়, আর দশটা মেয়ের মতো এই মেয়েটিও শরীর এবং সেই সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে এক বোঝা আতংক এবং কুসংস্কার নিয়ে বড়ো হয়েছে। তার পৃথিবীতে দুজন নর-নারীর ভেতরকার শারীরিক সম্পর্কের চেয়ে নোংরা অশুচি বিষয় আর কিছু হতেই পারে না। তারপর যদি সেই সম্পর্ক হয় সম্পূর্ণ অপরিচিত এক পুরুষের সাথে, যাকে সে স্বামী হিসেবে তো দূরে থাকে, এক ছাদের নিচে থাকবার মতন সঙ্গী হিসেবেও মেনে নিতে পারেনি, তাহলে পরিণাম কী হতে পারে সেটা বলাই বাহুল্য।

রাগে অভিমানে পাথর হয়ে যাওয়া মেয়েটি বিয়ের রাতেও সেই পাথরের মতোই থেকে গিয়েছিলো। এখানে বলে রাখি, যেই পাত্রটির সাথে তার বিয়ে হয়েছিল, তার কিন্তু এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা এবং আকাঙ্খা, কোনোটারই কমতি ছিল না। বিয়ের সময় নিষ্পাপ কুমারী মেরীর মতো পাত্রী খুঁজলেও আদতে তাঁর স্বপ্নের শয্যাসঙ্গীটিকে তিনি চেয়েছিলেন অভিজ্ঞ মেরি ম্যাগডেলিনের মতন হতে। বলাই বাহুল্য জোর মেলেনি। সাধ পূরণ হয়নি তার।

প্রথমে মিষ্টি কথায় না বোঝাতে পেরে অবশেষে নববিবাহিত স্ত্রীকে কায়দা করতে ধারালো ছুরির ভয় দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে হয় তাকে। সেই শুরু। তারপরের প্রায় ১৬/১৭ বছরের ইতিহাস একটানা প্রতিরাত ছুরির মুখে মেয়েটির ধর্ষিত হবার ইতিহাস। আর তা নাহলে স্বামীটির আস্ফালন গৃহকর্মীর শয্যায়।

সেদিনের সেই মেয়েটি আজ প্রৌঢ়া। এখনো সেই স্বামীর সাথেই সংসার তার, যদিও শয্যা আলাদা হয়েছে বহু বছর, সেই সময়ের অশুচি অনুভবটুকু শরীর ছেড়ে আত্মায় স্থান নিয়েছে, যার প্রকাশ প্রতিদিনের হাজারো শুচিবায়ুগ্রস্ত আচারে আর আচরণে। আমি সেই মেয়েটিকে প্রাণহীন হয়ে শুকিয়ে যেতে, নিঃস্ব হয়ে যেতে দেখেছি। আমি সেই ধারালো ভোজালির চকচকে ফোলা দেখেছি। দেখেছি সেই অসুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানদেরও।

আপনারা ঠিক এই মেয়েটিকে না দেখে থাকতে পারেন, কিন্তু একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, আপনাদের আশেপাশে প্রতিটি পরিবারেই এরকম অন্তত একটি করে গল্প আছে। আমি আজ একটিমাত্র গল্প শোনালাম, কিন্তু আমার চোখের সামনেই এমন আরো অসংখ্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি এবং দেখছি প্রতিনিয়ত।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অন্য সবরকম ঘটনায়, ছোট যেখানে শরীরের বাইরে, সমাজের হিসেবে গোপন কোন জায়গায় নয়, সেইসব আঘাতের চিহ্ন থাকলে সহানুভূতি পাওয়াটা তো সহজ হয়ই, আইনের সামনে অপরাধ প্রমাণেও সুবিধা বিস্তর।

স্বামী কিংবা প্রেমিকের হাতে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি কোন প্রমাণ নিয়ে সামনে এগোবে? বিয়ে হলে তো যা ইচ্ছে তাই করা যাবে, বিয়ে করা বৌ সম্পত্তি বলে কথা, এবং এ ধারণা যে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই প্রচলিত, তাও নয়। আর বিয়ের আগে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তো নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হয় মেয়েটির চরিত্রের সমস্যা ছিল। বিয়ের আগে প্রেমিকের সাথে শোয় যে মেয়ে, তার তো এই হওয়া উচিত!

পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সবাই আমরা এই সুরে তাল মেলাই। বিবাহ সম্পর্কিত ধর্ষণ নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ কোথায়!

একদিকে ইসলাম নারীকে শস্যক্ষেত্র করে পুরুষকে যখন যেমন ইচ্ছে অবাধ হালচাষের অনুমতি দিয়েই রেখেছে, অন্যদিকে হিন্দু ধর্ম নারীকে বলেছে বিছানায় স্বর্গের অপ্সরার মতো, রম্ভার মতো নিপুণতায় স্বামীকে তৃপ্ত করতে। তা এইসব করতে গিয়ে স্বামী দেবতাটি রেগে গিয়ে একটু আধটু জোর জবরদস্তি করতেই পারে, কী বলেন?

বড়জোর সারা রাত অত্যাচারের পর পরদিন বাজার থেকে একটা দামি শাড়ি কী গয়না এনে দিলেই হয়! এতো চিৎকার চেঁচামেচির কী আছে? কাজটা তো আর বাইরের কেউ করেনি, বিয়ে করা স্বামীই করেছে।

চারিদিকে এইসব সভ্য ও শিক্ষিত নারী পুরুষের এইরকম সব বক্তব্য শুনি, আর শিউরে উঠি।

ভাবি, কোথায় যাচ্ছি আমরা।

আমরা কি তবে ক্রমশ পেছনের দিকেই যাচ্ছি?

আপনাদের প্রতি তাই একটাই অনুরোধ, আপনারা হয়তো এই সমাজের অপেক্ষাকৃত প্রিভিলেজড অংশে জন্ম ও বেড়ে ওঠার সুবাদে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাক্ষিণ্যে পাওয়া ওপরের স্বাধীন স্বাধীন ভাবটুকু নিয়ে বেশ নিরাপদেই আছেন, কিন্তু তাই বলে যেখানে এখনো অন্যায় এবং শোষণ চলছে, তাকে অন্যায় এবং শোষণ বলেই চিনতে শিখুন।

নারীর ওপর অত্যাচারকে হাসি-তামাশার বিষয় করে তুলবেন না যেন। সভ্যতার জমে ওঠা পুঞ্জীভূত পাপে যেদিন আগুন লাগবে, সেদিন কিন্তু আপনাদের বোকার স্বর্গও তা থেকে রেহাই পাবে না! হাজার শপিং আর শাড়ি গয়নাতেও তার থেকে বাঁচবার পথ মিলবে না!


(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। আওয়ার নিউজ বিডি’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আওয়ার নিউজ বিডি আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না)



মন্তব্য চালু নেই