বীরশ্রেষ্ঠ’র সঙ্গে ৪৪ বছর: একজন দয়াল কৃষ্ণ চাকমার গল্প!

বয়সের ভারে ঘোলা হয়ে আসা চোখে এখনও দূর অতীতে ফিরে তাকান দয়াল কৃষ্ণ চাকমা। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পান সুসজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে একদল দামাল বাঙালি যুবকের তুমুল প্রতিরোধ যুদ্ধ। গাছের ওপর বসে সেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলেন দয়াল। এত বছর পরেও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল অসীমসাহসী বাঙালি যুবক মুন্সী আব্দুর রউফের লড়াই। যুদ্ধের পর সবাই যখন ফিরে গেছে যার যার গন্তব্যে, তখন নিথর পড়ে থাকা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের মরদেহ পরম যত্নে সমাহিত করেছিলেন এই দয়াল কৃষ্ণ। শুধু সমাহিত করাই নয়, এরপর দীর্ঘ ২৬ বছর পরম যত্নে ওই বীর সেনানির সমাধি পাহারা দিয়েছেন তিনি। এখনও সেই সমাধির পাহারাদার তিনি।

মুন্সী আব্দুর রউফ যে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পেয়েছেন তাও জানতেন না দয়াল। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত আগ্রহে বিডিআর (এখন বিজিবি) মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি খুঁজে বের করতে মাঠে নামে। তখন এই দয়ালকৃষ্ণের সহায়তায় খোঁজ মেলে সেই টিলার যার ওপর মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধির। সেই থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি এবং সেই সঙ্গে দয়াল কৃষ্ণ চাকমাও। মুন্সী আব্দুর রউফের মা মুকিদুন্নেছা তাই ছেলের সমাধি খুঁজে পেয়ে দয়ালকে নিজের আরেক ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

কী ঘটেছিল সেদিন

১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল। প্রতিদিনের মতোই সেদিনও কাজের সন্ধানে বের হয়েছিলেন দয়াল কৃঞ্চ চাকমা। হঠাৎ দেখতে পান বুড়িঘাট এর চেঙ্গী নদীতে কয়েকটি সুসজ্জিত নৌযান ও গানবোট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা এলাকায় ঢুকে পড়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। তিনি কিছু বুঝে উঠার আগেই নৌযানগুলো থেকে শুরু হয় গোলাবর্ষণ। ভয়ে গাছে উঠে বসেন দয়াল। তখনই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ। হানাদারদের ভারি অস্ত্রের বিরুদ্ধে হালকা অস্ত্র নিয়ে বাঙালির দুর্দান্ত লড়াইয়ে বিস্মিত হন তিনি। বাঙালি যোদ্ধাদের প্রতিরোধে হানাদারদের দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট নদীতেই ধ্বংস হয়ে যায়। হতাহত হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অসংখ্য সেনা।

রউফ

অতিরিক্ত পাকিস্তানি সেনার বহর যুদ্ধে যোগ দিলে তাদের তীব্র আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে পিছু হটতে শুরু করেন। কমান্ডার চিৎকার করে সবাইকে পিছু হঠার নির্দেশ দিলে মুন্সী আব্দুর রউফ (দয়াল তখনও নাম বা পরিচয় জানতেন না) পাল্টা কমান্ডারকে জবাব দেন, ‘আমি ওদের (পাকিস্তানি বাহিনী) ঠেকিয়ে রাখছি, আপনি পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে নিরাপদে পিছু হটে যান।’

রউফের একক প্রতিরোধের কারণে প্রাণ বাঁচে অন্তত ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে হঠাৎ কয়েকটি মর্টার শেল এসে আঘাত হানে মুন্সী আব্দুর রউফের গায়ে। এরপর সব শেষ। পাকিস্তানি বাহিনীও ফিরে যায় নিজেদের ঘাঁটিতে। গাছ থেকে নেমে আসেন দয়াল। নিজ চোখে দেখা এক অসীম সাহসী যোদ্ধার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে মন কেঁদে উঠে তার। পরম মমতায় তাকে দাফন করেন তিনি। দাফনের ইসলামী নিয়ম হয়তো তিনি জানতেন না। কিন্তু ভালোবাসা আর সম্মানের কমতি হয়নি। সেই ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই অচেনা যুবকের কবর এক আশ্চর্য শ্রদ্ধায় পরিচর্যা করে গেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, সেদিন পথ হারিয়ে ফেলা তিন মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার পর নিরাপদে ফিরে যেতে পথ চিনিয়ে দিয়ে তিনি পালন করেছিলেন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

বীরশ্রেষ্ঠের কবরের খোঁজ

১৯৯৭ সালে সরকারি উদ্যোগে খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু হয় সব বীরশ্রেষ্ঠ’র সমাধির। সেই সময় বুড়িঘাট যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা ও বর্তমানে রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর দেওয়া তথ্য মতে দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে খুঁজে বের করা হয়। পরে দয়ালের সহযোগিতায় খোঁজ মিলে মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধির। সরকারি উদ্যোগে সংস্কার ও পরে আধুনিকায়ন হয় এই বীরের সমাধির। কিছু সহায়তা মেলে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার কপালেও।

Rangamate120151208041853

একজন বীরশ্রেষ্ঠকে দাফন করে দীর্ঘদিন তার কবর রক্ষণাবেক্ষণ করা, পথহারা মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চিনিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করাসহ তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন করার আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়। নানিয়ারচর উপজেলা প্রশাসন ও রাঙামাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু তারপরও কাজের কাজ কিছু হয়নি। দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধির তত্ত্বাবধানের বিনিময়ে কিছু মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা তিনি পান না বলে জানিয়েছেন। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে পাঁচশ বা একহাজার টাকা পান, এছাড়া আর কোনও সরকারি সহায়তা নেই তার।

তবে দয়াল কৃষ্ণ বলেন, ‘সরকারিভাবে কী পেলাম আর কী পেলাম না তা নিয়ে এখন আর ভাবি না। আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানরাও এই সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ করবে।’

ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার সালামতপুর গ্রামের এক যুবকের সাথে পার্বত্য রাঙামাটির দুর্গম নানিয়ারচর উপজেলার ভাঙ্গামুড়া গ্রামের একজন দয়াল কৃষ্ণ চাকমা এইভাবে সৃষ্টি হয় এক হৃদ্যতার গল্পের। পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দীর্ঘসময়ের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘর্ষও যেই সম্পর্কে কোনোদিনও ন্যুনতম চিড় ধরাতে পারেনি। এ গল্প তাই এখনও সবার মুখে মুখে….এ গল্পের কোনও শেষ নেই।-বাংলা ট্রিবিউন



মন্তব্য চালু নেই