বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বাবাকে মারলো ছেলে

দুপুর বেলা। ক্ষেত থেকে সবজি এনে কাটাকাটি করছিলেন অফিলা বেগম। পাশেই বসেছিলেন তার স্বামী ৭১ বছরের মুনতাজ উদ্দিন। ঠিক তখনই তাদের ছোট ছেলে তমিজ উদ্দিন এসে বাবার কাছে দাবি করে ৫০০ টাকা।

‘দুই দিন আগেই তো তোমার মা তোমাকে ৫০০ টাকা ধার করে এনে দিল। এখন আবার কোত্থেকে টাকা দেব?’ মুনতাজ উদ্দিন এ কথা বলতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তমিজ। কোমর থেকে পিস্তল বের করে বাবার বুকে ঠেকিয়ে আলমারির চাবি চায় সে। কিন্তু চাবি না দেওয়ায় বুকে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটে বাবার। অথচ ছোট ছেলেকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন বাবা।

ছোটবেলায় সবসময় তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। কোলেপিঠে করে রাখতেন। উৎসব-অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। বড় হয়ে তমিজ ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়লে পরিবারের সদস্যরা তাকে আলাদা করে দেয়। তবুও মা-বাবা গোপনে তাকে খাবার দিতেন। চিকিৎসা করাতেন সেই সন্তানই নেশার ঘোরে হত্যা করল তার বাবাকে।

গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় এই করুণ ও নির্মম ঘটনা ঘটেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের হযরতপুরের জগন্নাথপুর গ্রামে। ছেলের পিস্তলের গুলিতে মুনতাজ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মা অফিলা বেগমের চিৎকারে গ্রামের লোকজন ছুটে আসে। পালিয়ে যায় তমিজ উদ্দিন। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় গুলিবিদ্ধ মুনতাজ উদ্দিনকে পাশের কলাতিয়া ইউনিয়নের হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কতর্ব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর সারা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ এসে ভিড় জমায় মুনতাজের বাড়িতে।

কেরানীগঞ্জ মডেল থানা সার্কেল এএসপি রামারন্দ বলেন, ‘সন্তানের হাতে পিতা খুন হওয়ার কথা জেনে আমরা হতবাক হয়েছি। তাকে ধরতে পারলে বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানা যাবে, অস্ত্রের রহস্যও বেরিয়ে আসবে।’ এ ঘটনায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।

সরেজমিন হযরতপুর গ্রামে গিয়ে নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জগন্নাথপুর গ্রামের মৃত করম উদ্দিন বেপারীর ছেলে মো. মুনতাজ উদ্দিন। তার চার ছেলে মো. মোখলেস উদ্দিন, চিনি মিয়া, মনু মিয়া ও মো. তমিজ উদ্দিন এবং দুই মেয়ে মমতা বেগম ও সূর্য বেগম। ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে তমিজ সবার ছোট। তাকে খুবই ভালোবাসতেন বাবা। দারিদ্র্যের কারণে তৃতীয় শ্রেণীর পর তমিজের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। টেইলার্সে শিক্ষানবিশ হিসেবে সে কাজ শুরু করে। কাজকর্মে সে প্রশংসা পেতে থাকে। তাছাড়া এলাকায়ও সে পরিচিত ছিল ভদ্র ছেলে হিসেবে।

যেভাবে তমিজ পাল্টে গেল: গত কয়েক বছর ধরে তমিজের আচরণ পাল্টাতে শুরু করে। মা-বাবার সঙ্গে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করতে থাকে সে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকার প্রভাবশালী সন্ত্রাসী রানা মোল্লার বাহিনীর সঙ্গে চলাফেরা শুরু করার পর থেকে তার ভেতর পরিবর্তন শুরু হয়। মা-বাবার সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করতে থাকে তমিজ। এ সময় সে ইয়াবা আর ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পড়ে। কিছুদিন পর পরই বাবা-মার কাছে টাকা-পয়সা দাবি করতে থাকে। টাকা না দিলে অকথ্য ভাষায় গালাগালিও করত সে।

বাবা খুব ভালোবাসতেন ছেলেকে: নিহত মুনতাজ উদ্দিনের স্ত্রী অফিলা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘যে পোলাকে হে (মুনতাজ উদ্দিন) নিজের জীবনের চাইতে বেশি ভালোবাসত, আজ হেই পোলায় তারে বুকে পিস্তল ঠেকাইয়া গুলি কইরা মারল! হে তাকে কত মায়া করত!’ তিনি বলেন, ‘নেশা কইরা কইরা পোলাডা অমানুষ হইছে। তমিজ পহেলা বৈশাখের দিনও আমার কাছথে ৫০০ টাকা নিছে। সেই টাকাও ধার কইরা আইন্যা দিছি।’

নিহত মুনতাজ উদ্দিনের বড় ছেলে মোখলেস উদ্দিন বলেন, ‘অন্য ছেলেমেয়ের চেয়ে তমিজের দিকে ছোটবেলা থেকেই বাবার টান একটু বেশি। আজ সেই ভাই-ই ইয়াবার নেশায় আসক্ত হয়ে বাবাকে গুলি করে মারল।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘তমিজ নেশা করে বলে ও আলাদা থাকত। মা-বাবা আমার সঙ্গে থাকেন। কিন্তু মা-বাবা অনেক সময়ই আমার ঘর থেকে লুকিয়ে খাবার নিয়ে তমিজকে খাওয়াতেন।’

নিহতের বড় মেয়ে মমতা বেগম বলেন, ‘কয়েকদিন আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তমিজ আহত হয়েছিল। অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করা টাকায় তার চিকিৎসা করায় বাবা। কয়েক দিন আগে বাবার বাড়িতে গেলে আমার হাত দুইটা ধইরা কয়, মা রে, আমি মইরা গেলে ছোট পোলাডারে তোরা একটু দেখিস। তোরা না দেখলে কে দেখব? আজ হেই বাবাকেই ও ক্যামনে গুলি করে মারল? এই কথা মনে হইলেই বুক ফাইট্যা যায়।’

মুনতাজের আরেক ছেলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘জগন্নাথপুরের সন্ত্রাস এবং মাদকের হোতা কে আপনারা খুঁজে বের করুন। খুঁজে দেখুন, কাদের কারণে আমার ভাইটি নেশায় জড়িতে পড়ছে। কারা ওর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। শুধু আমার ভাই নয়, অনেকের ছেলেই এখানে নেশার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।’

ভয়াল নেশা এবং একজন রানা মোল্লা: হযরতপুর ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আয়নাল বলেন, ‘তমিজ উদ্দিন ইয়াবা নিত। নেশা করতো। কিন্তু মাদকের ব্যবসা কারা করছে, এত গরিব পরিবারের সন্তানদের কাছে পিস্তল কোথা থেকে আসছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে এলাকায় গ্রাম কমিটি করা হবে।’

মুনতাজ উদ্দিনের প্রতিবেশী মানোয়ারা বেগম ও জাকিয়া খাতুন বলেন, ‘একটি দরিদ্র পরিবারের ছেলে মাদকের নেশায় কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, সেটা আমরা দেখতে পেলাম।’

গ্রামবাসীদের মতে, হযরতপুর ইউনিয়নে বর্তমানে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তমিজ উদ্দিন অনেক শান্ত প্রকৃতির ছিল। এক পর্যায়ে সে নেশায় জড়িয়ে পড়ে, রানা মোল্লার বাহিনীর সঙ্গে ঘোরাফেরা শুরু করে। তারা জানান, ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামেই মাদক ঢুকে পড়েছে।

স্থানীয় যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হযরতপুর ইউনিয়নটি শান্ত ছিল। প্রায় ৭ বছর হয় রানা মোল্লা হযরতপুরে এসে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছে। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য তমিজ উদ্দিন।’ গত ৭ এপ্রিল, ২০১৬ সমকালে রানা মোল্লাকে নিয়ে “নতুন চেয়ারম্যানের আশ্রয়ে ‘শুভ হত্যাকারী’ রানা” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। -সমকাল



মন্তব্য চালু নেই