বেশি মারধরে শিকার তিন-চার বছরের শিশুরা

আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। শিশুদের উপরই নির্ভর করে জাতির ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের উন্নয়নে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এই শিশুদের এমন একটি পরিবেশে বেড়ে উঠতে হবে যেখানে তারা সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্নিক এবং সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে।

শিশুরা কারো দয়া বা অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। প্রয়োজন শিশুদের অধিকার সম্বলিত প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন। এই বাস্তবতা থেকেই জাতীয় ও আন্তজার্তিক পর্যায়ে চলছে শিশু অধিকার নিয়ে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের সার্বিক এই পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। দারিদ্রের কষাঘাতে এ দেশের অধিকাংশ শিশু প্রতিনিয়ত তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, বিকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর এক জরিপে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ (৬৫.৯%) শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেন মা-বাবা। সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয় তিন-চার বছরের শিশুদের। মা-বাবাসহ অভিভাবকরা ৭৪.৪% শিশুকে শৃংখলা শেখানোর জন্য মানসিক চাপ প্রয়োগ করেন। বিদ্যালয়েও শিশুর সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়।

বাংলাদেশে শিশু পুষ্টিরও চিত্রও হতাশাজনক। অভিভাবকদের দারিদ্রতা ও অজ্ঞতার কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ডের সূচক অনুসারে একটি দেশে শতকরা ৪০ ভাগ বয়সের তুলনায় বেঁটে, শতকরা ৩০ ভাগ বয়সের তুলনায় কম ওজন এবং শতকরা ১৫ ভাগ উচ্চ তার তুলনায় কম ওজন হলে মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

সূচক হিসেবে এসব ক্ষেত্রের নিচেই রয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের বিশ্ব পুষ্টি পরিস্থিতি বিষয়ক ষষ্ঠ রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪০.২ ভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার।

দেশের ছিন্নমূল শিশুরা পেটের দায়ে টোকাই হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে, কখনও বা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। শিশুদের এ অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য সরকারি- বেসরকারি, আন্তজার্তিক সনদ ও প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এগুলো প্রতিপালিত হচ্ছে না।

শিশু অধিকার সনদে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা হলো-

১. শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার যেমন- স্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টিকর খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ।

২.বিকাশের অধিকার যেমন- শিক্ষার অধিকার, শিশুর গড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত একটি জীবনযাত্রার মানভোগের অধিকার, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার ।

৩. সুরক্ষার অধিকার যেমন- শরণার্থী শিশু, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু, শোষণ নির্যাতন ও অবহেলিত শিশু।

৪. অংশগ্রহণের অধিকার , যেমন শিশুদেও স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, তথ্য ও ধারনা চাওয়া পাওয়া ও প্রকাশের অধিকার, অবাধে সম্পর্ক গড়ে তোলার অধিকার।

শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে দেশে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ নীতি বাস্তবায়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং শিশুশ্রম বিষয়ক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেভ দ্যা চিলড্রেনের সহায়তায় শিশুদের জন্য ‘জাতীয় ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের সুরক্ষায় সরকারের গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

তবে ইদানিং শিশু নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিদিন শিশু নির্যাতনের অনেক চিত্র আমরা দেখতে পাই। সিলেটের রাজন, খুলনার রাকিব ও বরগুনার রবিউলের মতো আরো অসংখ্য শিশু নির্যাতনের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিকৃত মানসিকতা এবং পরিবারের নৈতিকতার চর্চা কমে যাওয়ার জন্য নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান নেই। এজন্য কঠিন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন। কাজ করতে আমাদের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারেন দেশের সচেতন সমাজের লোকজন যেমন- সাহিত্যিক-কবি, রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ,নাট্যকার , অভিনেতা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সমাজকর্মী। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যমসহ সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে আরও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।



মন্তব্য চালু নেই