ভারী বর্ষনে কক্সবাজারে পাহাড় ধসের আশংকা

মোঃ আমান উল্লাহ, কক্সবাজার : চলতি বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাত হলেই কক্সবাজারে ভয়াবহ পাহাড় ধসের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কক্সবাজারের বিভিন্ন পহাড়ে যেভাবে অবৈধ বসবাসকারীর সংখ্যা বেড়েছে এতে সকলকেই সর্তক থাকতে হবে না হয় ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা আরো বেড়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের চেয়ারম্যান ডঃ মুহিবুল্লাহ জানিয়েছেন, কক্সবাজার ভুমিকম্প ঝুঁকি প্রবণ এলাকা। পাহাড়ে বসতি গড়তে পাহাড় কাটতে হয়। পাহাড় ধস হবে এমন চিন্তা না করেই তারা বসতি গড়ে তুলেন। বিষয়টির ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে যেভাবে কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ে বসতি স্থাপন করা হয়েছে তা চরমভাবে ঝুঁিকর মধ্যে পড়ে। বিগত সময়ে কক্সবাজারে অনেকবার পাহাড় ধস হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যথা সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না। অসময়ে বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের ঝুকি বাড়ে। এ ছাড়াও ভারী বৃষ্টি ও একই সাথে ৬ মাত্রার ভুমিকম্প হলেই বড় ধরণের পাহাড় ধস হতে পারে। তাই আগে বাগেই ঝুঁকিতে বসবাসরত সরিয়ে আনা প্রয়োজন।

অধ্যাপক জাফর আলম জানান, কোন বাধা ছাড়াই পাহাড়ে বসতি গড়তে পারাই দিনদিন ঝুঁকিপূর্ণ বসতবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। কক্সবাজারের পাহাড়ে কোন গাছপালা দেখা যায় না। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই বসতবাড়ি। এভাবে অবৈধ বসতবাড়ি গড়ে তুললেও কোন বাধা আসছে না প্রশাসন থেকে। অনেকেই পাহাড় দখল করে ব্যবসায় নেমেছে। প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে পাহাড়ি জমি। প্রভাবশালীদের দৃষ্টি এখন পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ে যে বসতবাড়ি রয়েছে তার অধিকাংশই পাহারাদাররা বসবাস করে। মালিক পরিবর্তন হলে পাহারাদারও পরিবর্তন হয়। অনেক বসতবাড়ি সন্ত্রাসিদের আস্তানা হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

খাজা মঞ্জিলের পাশে পাহাড়ে বসাবাসকারী এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে বলেন আমার বাবা প্রায় ১০ বছর আগে এখানে ৭ গন্ডা জমি কিনেছিলেন উনি মারা যাওয়ার পর ভাই বোনে ভাগ করে আমি দেড় গন্ডা জমির উপর একটি কাচা বাড়ি করে বসাবাস করছি। আমাদের আর কোথাও কোন জমি জমা নেই। দিন মজুর হিসাবে কাজ করে কোন মতে খেয়ে পরে বেচে আছি। এখন সরকার যদি আমাদের পাহাড়ের ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলে কোথায় যাব। তিনি বলেন আমরা বুঝতে পারছি সরকার আমাদের ভালর জন্য বলছে। কিন্তুু আমাদের আসল বাস্তবতা অনেক কঠিন। কেউ বেড়াতে গেলেও পর দিন তার ঘর ভিটা দখল হয়ে যায়। আবার সন্ত্রাসীদের টাকা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়।’

বৈদ্যঘোনর মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন- ‘আমরা সবাই জানি পাহাড় সরকারী খাস জমি। কিন্তু খাস জমি যে যুগ যুগ ধরে শক্তিশালী গোষ্ঠি দখল করে বেচা বিক্রি করছে তখন প্রশাসন কোথায় ছিল? প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল পাহাড়ে ঘর বাধার আগেই তাতে বাধা দেয়া। এখানে ১ গন্ডা জমি ২/৩ লাখ টাকাও কিনে মানুষ বসাবাস করছে । এখন তার ক্ষতি পূরন বা তাদের জীবনের মূল্য কে দেবে। আমরা দরকার হলে জীবন দেব তবুও পাহাড়ের জমি ছেড়ে কোথাও যাব না।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় গত বছর কক্সবাজারে পাহাড় ধ্বসে শহরে ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পরে জেলা প্রশাসন ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই জেলা প্রশাসন পাহাড়ে বসবাসকারীদের বিরুদ্বে অভিযান চালায়। এতে সাধারন মানুষের মাঝে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হয়।

কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, মূলত কেউ পাহাড়ে শুরুতে ছোট ঘর তৈরি করে। পরে আস্তে আস্তে পাহাড় কেটে সব জমি নিজেদের দাবী করে। আমি সব সময় বলি পাহাড় কাটা বন্ধ হলে শহরের অর্ধেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। আর সরকার মানুষের উপকারের জন্য কাজ করছে এটা মানুষের বুঝা উচিত।

জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন বলেন, মানবিকতা এক জিনিস। জীবনের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। আবেগ দিয়ে নয় বাস্তবতা বুঝা উচিত। সহায় সম্পদ ঘর বাড়ি মানুষ চাইলে আবার অর্জন করতে পারবে। কিন্তু জীবন চলে গেলে তা আবার আসবে না। তার জন্য সারা জীবন কান্না করতে হবে। তিনি বলেন সরকারী জমিতে বসাবাস অপরাধ। সে অর্থে জেলা প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করছে। কক্সবাজারের পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণ বসাবাসকারীদের উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় কক্সবাজারে বেড়েই চলেছে বনভুমি দখল করে বসতবাড়ি নির্মাণকারীর সংখ্যা। সম্প্রতি প্রায় সাড়ে ১০ হাজার একর বনভূমি দখল করে অবৈধভাবে বসবাস করছে প্রায় ১০ লাখেরও বেশী মানুষ। এর মধ্যে ৩ লাখ মানুষ রয়েছে পাহাড় ধ্বসের চরম ঝুঁকিতে। গত ৫ বছরে পাহাড় ধ্বসে প্রায় ২০০ জন মানুষ। ২০১০ সালের ১৫ জুন ভোরে টানা বৃষ্টির কারণে জেলাব্যাপি ব্যাপক জলাবদ্ধতার পাশাপাশি ভয়াবহ পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটে। এতে রামু উপজেলার হিমছড়ি এলাকার ১৭ ইসিবি সেনা ক্যাম্পের ৬ জন সেনা সদস্যসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বসে মারা যায় প্রায় ৬২ জন। ২০১৩ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফে ফকিরা মুরা ও টুন্যার পাহাড় ধসের একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় মারা গেছেন ২৯ জন। একই ভাবে ২০০৯ ও ২০০৮ সালেও পাহাড় ধ্বসে মারা যায় প্রায় ১৯ জন লোক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের ঘোনার পাড়া, মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, বইল্যাপাড়া, জাদি পাহাড়, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশাঘোনা, ফাতেরঘোনা, ইসলামপুর, হালিমা পাড়া, লাইট হাউজ পাড়া, সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এলাকা, আবু উকিলের ঘোনা, রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকা, পাহাড়তলী, বাঁচা মিয়ারঘোনা, হাশেমিয়া মাদ্রাসার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিডিআর ক্যাম্পের পিছনে, লারপাড়া, সদর উপজেলা কার্যালয়ের পিছনে, পাওয়ার হাউস, লিংকরোড, কলাতলী বাইপাস সড়কের দুই পাশের বিশাল পাহাড়ী এলাকা, হিমছড়িসহজেলা শহরের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়কাটা চলছে। কক্সবাজার সদরের পিএমখালী ইউনিয়নের তোতুকখালী, মাঝেরপাড়া, কাওয়ারপাড়া, ছয় ভাইয়েরপাড়া, জুমছড়ি, পাতলী, মাছুয়াখালী, ধাউনখালী, পুতিরমারঢালা, চেরাংঘর, উসমানেরঢালা, পরানিয়াপাড়া, পুরাকাটা, সিকদারঘোনা, টাইমাঝিরঘোনা, কাঠালিয়ামোরা, সিকদারপাড়া, ঘাটকুলিয়াপাড়া, টাইমোহাম্মদেরঘোনা, সাতঘরিয়াপাড়া, ছনখোলা, নয়াপাড়া, ঘোনারপাড়া, মালিপাড়া, পশ্চিমপাড়া, মাদলিয়াপাড়াসহ ২৯টি এলাকার ৩৭টি পাহাড় নিধন চলছে প্রকাশ্যে। টেকনাফ, রামু, সদর উপজেলা, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে গড়ে তুলেছে অবৈধ বসতি। এসব বসতি রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।



মন্তব্য চালু নেই