ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু : উল্টো চিকিৎসকই হুমকি দিচ্ছেন

জন্মের ১২ দিনের মাথায় মাকে হারিয়ে ফেলা শিশু আজওয়া এখন হাঁটতে শিখেছে। মায়ের ভালোবাসা আর পরিচর্যা না পাওয়া আজওয়ার বয়স এখন বছর পার। কিন্তু যে চিকিৎসকের অবহেলার কারণে মা বিলকিস বেগমের (আইরিন) অকালে চলে যাওয়া সেই চিকিৎসক আবদুল কাইয়ুমই কিনা এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। পেটে গজ রেখে অপারেশন করায় ইনফেকশনে মারা যান বিলকিস বেগম।

এ ব্যাপারে নিউরো মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক গোবিন্দ বণিক জানান, অস্ত্রোপচারে চিকিৎসকরা ইচ্ছে করে অঘটন ঘটান না। তবে অসতর্কতা ও অবহেলার ফলে ঘটে তাও ঠিক। তাড়াহুড়া করে অস্ত্রোপচারেও এমন হতে পারে। চিকিৎসক এবং তার সহযোগিতায় থাকা নার্স সবাই একসঙ্গে বিষয়টি ইগনোর করলেন এটা কী করে হয়!

অন্যদিকে চিকিৎসকের ‘ভুলের’ কারণে বিলকিসের এই চলে যাওয়াকে ‘হত্যা’ বলছে তার পরিবার। বিলকিসের বোনজামাই অ্যাডভোকেট নিজামউদ্দিন ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাদী হয়ে ফেনীর সেই ‘ঘাতক’ চিকিৎসক আব্দুল কাইয়ুমের বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলায় ডা. আবদুল কাইয়ুমকে প্রধান আসামি এবং ফেনী প্রাইভেট হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স লিপি ও আরেক সিনিয়র স্টাফ নার্স রুমিকেও আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। যদিও অভিযুক্ত চিকিৎসক এখন অবধি রয়েছেন বহালে তবিয়তে। মামলা চললেও করেছেন ইতালি সফর।

মামলা দায়েরের পর থেকে বাদী পক্ষকে সমঝোতার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় এখন মামলা উঠিয়ে নিতে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। মামলার বাদী পক্ষ, আইনজীবী ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

নিহত বিলকিসের স্বামী লুৎফুল করিম দুলাল জানান, ‘আমার ফার্মেসির দোকান আছে। সেই সুবাদে চিকিৎসক আব্দুল কাইয়ুমকে চিনতাম। স্ত্রী বিলকিস অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর স্বাস্থ্য পরামর্শ ডা. আবদুল কাইয়ুমের কাছেই নেয়া হতো।

ফেনী জেলা গাইনোকলজি সমিতির সভাপতি ডা. কাইয়ুমের পরামর্শেই মহিপালে এস এস কে রোডে তার মালিকানাধীন একটি ক্লিনিকে ডেলিভারির ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হয়। যদিও হাসপাতালটি তখনো নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।

আইরিনের ডেলিভারির নির্ধারিত সম্ভাব্য তারিখ ছিল গত বছরে ১৯ জুন। কিন্তু হঠাৎ ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় ৭ জুন সেখানে ভর্তি করা হয়। রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১৮ এর বিপরীতে হাসপাতালের ৪০৩ নং শয্যায় তার স্থান হয়। ভর্তির পর থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত আইরিন হাসপাতালে ছিলেন।

ডা. কাইয়ুম ৭ জুন সিজার পদ্ধতিতে প্রসবের আয়োজন সম্পন্ন করেন। আল্ট্রাসনো ছাড়াই তিনি রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দেন। কন্যা শিশুর জন্ম দেয়ার পর ১৪ তারিখে মা-শিশকে পুরোপুরি সুস্থ না হলেও ডাক্তারের পরামর্শে বাসায় নিয়ে আসা হয়। সাতদিন পর সাক্ষাৎ করতে বলেন।

কিন্তু বাড়ি আসার পর থেকে বিলকিসের অবস্থার অবনতি হলে দ্রুতই তাকে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলস কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৮ জুন ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন ইউনিট থেকে পরবর্তীতে চিকিৎসকরা সার্জারি ইউনিটে স্থানান্তর করেন। ২২ জুন পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়।

অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকের দেয়া রিপোর্ট উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। ‘জীবাণুরোধী প্রাক সাবধানতা অবলম্বন করে তলপেটের মাঝখান বরাবর কাটা হয়েছে। এরপর প্রায় ২২ পেরিটোনিয়াল রস বের করে আনা হয়েছে। বৃহদান্ত্রের ট্রান্সভার্স কোলন অংশের মাঝামাঝি অংশে একটা গজের টুকরা পাওয়া গেছে এবং প্রায় ৫০০ এমএলের মতো পুঁজ বের করা হয়েছে। চারটা ড্রেইন টিউব ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে। তারপর পুরো অংশ ভালোভাবে পরিষ্কার (পেরিটোনিয়াল টয়লেটিং) করা হয়েছে।’

বিলকিসকে ক্রিটেনিন প্রশমন ও নিবিড় পরিচর্যার স্বার্থে ২২ জুন ঢাকার গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরদিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মারা যান। তার মৃত্যুর প্রায় তিন মাস পর ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করেন বোনজামাই নিজামউদ্দিন।

মামলার বাদী নিজামউদ্দিন জানান, আইনি লড়াই চলাকালীন দীর্ঘ আট মাসে ওই চিকিৎসক নানাভাবে বিষয়টি নানাভাবে মীমাংসার চেষ্টা করছেন। ৫০ লাখ টাকাও প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় তিনি সম্প্রতি পুলিশ, রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন মামলা তুলে নেয়ার জন্য। ডা. কাইয়ুমের সহকর্মী খিজির হায়াৎ, অভীক ও বেলায়েত মিলে আইনি প্রক্রিয়া থামানোর চেষ্টায় আছেন।

নিজামউদ্দিন বলেন, এই মাসেই মামলায় আসামিপক্ষের গ্রেফতারের আদেশ চাওয়ার কথা রয়েছে। গ্রেফতার করে রিমাণ্ডে নিলে সব তথ্য বেড়িয়ে আসবে বলে জানান তিনি।

এদিকে এই মামলাটির পাশে দাঁড়িয়েছে মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র। আসকের আইনজীবী মিজানুর রহমান জানান, মামলার বাদী নিজাম উদ্দিনকে মিরপুর থানার ওসি ভূইয়া মাহবুব হাসান হয়রানির চেষ্টা করছেন। মিথ্যে অভিযোগ তুলে তিনি কয়েকদিন থেকে মামলার বাদীকে গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আদালতের নির্দেশে আমাকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। আমি ৬ মাস আগে সব রকমের ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে আদালতে উপস্থাপন করেছি।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ফেনীর সেই চিকিৎসক আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। আদালতের প্রতি আমার আস্থা আছে। সুতরাং কাউকে হয়রানি করার প্রশ্নেই ওঠে না।জাগো নিউজ



মন্তব্য চালু নেই