ভুয়া পাসপোর্টের নগরী

গ্রিক সভ্যতা পৃথিবীর বহু পুরাতন সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি। রাষ্ট্র পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নানান বিষয়ে উন্নত অবস্থানের জন্য গ্রিসকে আজও অগ্রগামী সভ্যতা হিসেবেই দাবি করা হয়। যদিও সেই অগ্রগামী সভ্যতার দেশ গ্রিসের অবস্থা এখন আর সেই আগের মতো নেই। গত কয়েক বছর ধরেই অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেশটিকে প্রায় অচল বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও অতীত ঐতিহ্য আর ইউরোপীয় দেশগুলোর সহায়তায় খুড়িয়ে হলেও দেশটি চলছিল। কিন্তু আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধেয়ে আসা শরণার্থীদের কারণে গ্রিসের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। দেশটির রাজধানী এথেন্সের পার্শ্ববর্তী একটি জাতীয় উদ্যানের নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক। ধীরে ধীরে এই পার্কটিই এখন পরিনত হয়েছে শরণার্থীদের আশ্রয়স্থলে।

গ্রিসে আসা শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই মূলত এসেছে আফগানিস্তান থেকে। এছাড়াও আছে সিরীয়, ইরানি এবং পাকিস্তানি অনেক নাগরিক। পার্কের ওই ছোট্টো পরিসরে ভয়ানক মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। গ্রিসের এই ভিক্টোরিয়া পার্কে এসে জড়ো হতে এই শরণার্থীদের পাড়ি দিতে হয়েছে সোমালিয়া, সুদান এবং ইরিত্রিয়ার মতো ভূখণ্ড। কখনও পায়ে হেটে, কখনও গাড়িতে চেপে। কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবাই চুটে চলছে একটু আশ্রয়ের সন্ধানে। বিশ্ব রাজনৈতিক অবস্থান প্রেক্ষিতে অধিকাংশ দেশই তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে শরণার্থীদের জন্য। এমতাবস্থায় অন্যান্য দেশের সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম বিপদে পরেছে গ্রিস। সম্প্রতি দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস গ্রিসকে ‘ওয়ারহাউস অব সোলস’ বলে আখ্যা দেন।

সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভিক্টোরিয়া পার্কে অবস্থানরত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় পঁচিশ হাজার। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে সরকার চাইলেও শরণার্থীদের কোনো সহায়তা করতে পারছে না। আর এই সুযোগে শহরের বিভিন্ন স্থানে বেড়ে চলেছে যৌনব্যবসা থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসার মতো অবৈধ কর্মকাণ্ড। অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মাঝে খুব সহজেই অপরাধ চক্র প্রবেশ করে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এখন গ্রিস।

শরণার্থী সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে আবার একদল মানুষ ব্যবসাও করছে। ভিক্টোরিয়া পার্কের আশেপাশের যতগুলো ক্যাফে দেখা যাবে সেখানে সর্বক্ষণ পাওয়া যাবে কোনো না কোনো মানবপাচারকারী, মধ্যস্বত্বভোগী এবং মাদকব্যবসায়ি। শরণার্থীদের ঢলকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত। সরকার যেখানে তার জনগণকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়, সেখানেই অপরাধী চক্র নিজেদের অলিখিত আইনের রাজত্ব কায়েম করে। সেই সূত্র ধরেই, গ্রিসের ভিক্টোরিয়া পার্কের মানবপাচারকারীরা তৈরি করেছে নিজেদের এক চোরাচালানি বলয়।

মোহাম্মদ নামের এক ইরানি শরণার্থী জানালেন, ‘যদি আপনি কোনো ক্যাফেতে পাঁচ মিনিট বসেন তবে কেউ না কেউ আপনাকে টাকার বিনিময়ে ইউরোপের কোনো দেশে পাঠিয়ে দেবার নিশ্চয়তার কথা বলবে। আমি নিশ্চিত তারা এটা অবৈধ উপায়েই করছে।’ উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে পরেছে যে, শরণার্থীদের হাতে ভুয়া পাসপোর্ট তুলে সীমান্ত পার করে দেয়ার জন্য অনেক মানুষ রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, শরণার্থীদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা এই ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবসায় জড়িয়ে গেছেন। কারণ সমুদ্রগর্ভে অগুনতি শরণার্থী মারা যাওয়ার পর এখন অনেক শরণার্থীই আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশত্যাগ করতে চাইছেন না। একটা ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে টাকার বিনিময়ে হলেও তারা স্বাভাবিক ভাবেই যেতে চান বিদেশে।

আমাদের সঙ্গে যিনি যোগাযোগ করেন তিনিও একজন মানবপাচারকারী। সুদানের অপর এক পাচারকারীর সঙ্গে তার কারবার। একটি পার্কের ধারেই যেখানে আরও অনেক শরণার্থীদের বসবাস, সেখানে তিনি আমাদের দুজনের দুটি ছবি নিলেন পাসপোর্টের জন্য এবং অপেক্ষা করতে বললেন তার ফোনের। পরদিন সন্ধ্যায় ওই ব্যক্তি আমাদের জন্য ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে আসলেন এবং জানালেন যে, পাসপোর্ট তৈরিতে ব্যয় হবে সাড়ে তিনশ ইউরো, যদি আমি রাজি থাকি তবেই আমার ছবিটি ল্যামনিটিং করা হবে। তখন আমি তাকে বললাম যে, আমি আপনাকে আগামীকাল সকাল দশটায় টাকা দেবো এবং আপনার কাছ থেকে পাসপোর্ট নেবো।

কিন্তু ওই ব্যক্তি আমাকে চাপাচাপি করতে লাগলেন আগাম কিছু অর্থের জন্য। তিনি বারবার বলছিলেন যে, আগাম কিছু অর্থ না দিলে তিনি পাসপোর্টের কাজ শুরু করতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, পাসপোর্টটি তিনি লেজার প্রিন্টার দিয়ে প্রিন্ট করাবেন এবং এই পাসপোর্ট দিয়েই আমি লন্ডন যেতে পারবো, তাই বোঝাতে লাগলেন বারবার। শেষমেষ আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে আগামীকালের কথা বলে চলে আসতে পারলাম। পরবর্তী দিনেও তিনি আমাকে অনেকবার ফোন দিয়েছিলেন কিন্তু আমি ফোন ধরিনি।

চোরাচালানির ব্যবসা এথেন্সে কয়েক ধাপে হয়ে থাকে। এমনকি গ্রিস পুলিশরা পর্যন্ত এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সবচেয়ে কমের মধ্যে স্প্যানিশ পাসপোর্টের খরচ আড়াইশ ডলার। কিন্তু ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টের খরচ প্রায় তিন হাজার ডলারেরও বেশি। এই ভুয়া পাসপোর্ট দিয়েই প্রতিদিন শত শত মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে উন্নত দেশের দিকে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার ভুয়া পাসপোর্ট ধরা খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এভাবেই চলছে গ্রিসের ভুয়া পাসপোর্ট বাণিজ্য।



মন্তব্য চালু নেই