ভোটের লড়াই যুক্তরাষ্ট্রে, উত্তেজনা বিশ্বজুড়ে

ইতিহাসে সবচেয়ে তিক্ততাপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণা শেষে ভোটযুদ্ধ চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট বেছে নেয়ার জন্য ভোট দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রবাসী। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোরে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণ শুরু হলেও আগাম ভোটগ্রহণ চলছে আগে থেকেই। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ মুহূর্তের একাধিক জরিপে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। বিশ্লেষকরা হিলারির জয়ের সম্ভাবনা বেশি দেখছেন। হিলারি বিজয়ী হলে ৯৫ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পাবে মার্কিনিরা। তবে প্রাথমিক তিনটি শহরের ফলে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ট টাম্প এগিয়ে থাকায় অনেকে আশঙ্কা করছেন শেষ মুহূর্তে নাটকীয় কিছু ঘটতেও পারে।

নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলেও এর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। কে হচ্ছেন সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রটির প্রধান সেই কৌতূহল সবার ভেতর। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। এদেশের মানুষের মধ্যেও মার্কিন নির্বাচন নিয়ে প্রচণ্ড কৌতূহল। গত কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ চায়ের কাপে ঝড় তুলছে মার্কিন নির্বাচন। অনেকের ধারণা, মার্কিন নির্বাচনে কে ক্ষমতায় আসছেন এর প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পড়বে।

মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ভোর ছয়টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। নিয়ম অনুযায়ী সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ০১ মিনিটে নিউ হ্যাম্পশায়ারের ছোট্ট গ্রাম ডিক্সভিলে নচের বাসিন্দারা সবার আগে ব্যালটে তাদের পছন্দের কথা জানান।

বুধবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে ফল ঘোষণা শুরু হওয়ার কথা। ভোট শুরুর ঠিক আগে জনমত জরিপ বলছে, পপুলার ভোট এবং ইলেক্টোরাল ভোট – দুই হিসাবেই ট্রাম্পের থেকে সামান্য এগিয়ে রয়েছেন হিলারি। এ বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডা, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনাসহ প্রায় ১৩টি স্টেটকে ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই স্টেটগুলিতে যিনি শেষ হাসি হাসবেন তার হাতেই হোয়াইট হাউসের চাবি দেখা যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নিউ হ্যাম্পশায়ারের ডিক্সভিলি নচ, হার্টস লোকেশন ও মিলসফিল্ড শহরে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। তিন শহরে মোট ভোটার ১০০ জনের কম। এর মধ্যে ট্রাম্প পেয়েছেন ৩২ আর হিলারি পেয়েছেন ২৫ ভোট।

ডিক্সভিল নচে মোট ভোটার আটজন। সেখানে হিলারি ক্লিনটন ৪-২ ভোটে ট্রাম্পকে হারান। হিলারির এ জয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল ডিক্সভিল থেকে সামান্য বড় শহর হার্টস লোকেশনেও। সেখানে হিলারি পান ১৭ ভোট। আর ট্রাম্প ১৪ ভোট। কিন্তু মিলসফিল্ডে ট্রাম্প পেয়েছেন ১৬ ভোট। আর হিলারি পেয়েছেন মাত্র ৪ ভোট।

কানাডা সীমান্ত থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে ডিক্সভিল নচে ১৯৪৮ সাল থেকে অন্যান্য রাজ্য থেকে আলাদা সময়ে ভোট দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫২ সালে ভোট দেয়ার সময়টি একবার পরিবর্তন করা হয়। ১৯৬৪ সাল থেকে তারা আবার নির্বাচনের দিন রাত ১২টা ১ মিনিটে ভোট দিয়ে আসছেন।

ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি

আমেরিকার রাজনীতিতে হিলারি ক্লিনটনের বেশ অনেকগুলো পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফার্স্ট লেডি, সেনেটার, এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এবার দ্বিতীয়বারের মতো তিনি তার দীর্ঘদিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবার লড়াইয়ে নেমেছেন। ২০০৮ সালে প্রথমবার ওবামার কাছে প্রাইমারি পর্যায়ে তিনি শোচনীয়ভাবে হেরে যান।

ডেমোক্রাট প্রার্থী ৬৮ বছর বয়স্ক হিলারি ২০০৯ সালে বারাক ওবামা প্রশাসনের শুরু থেকেই তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী পদে কাজ করেছেন। বারাক ওবামা পুর্ননির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পরে হিলারি এই পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন তার এই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দেশটির শীর্ষ পদের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়ক হবে।

হিলারি ডায়ান রডহ্যামের জন্ম শিকাগোয় ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে। ষাটের দশকে তিনি ম্যাসাচুসেটসের ওয়েলেসলি কলেজে পড়াশোনা করেন এবং সেসময়ই ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

পরবর্তী সময়ে পড়তে যান ইয়েল ল’ স্কুলে। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় বিল ক্লিনটনের। তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৮ সালে ক্লিনটন আরকানস-র গভর্নর হবার পর তিনি রাজনীতিতে তার সক্রিয় ভূমিকা অব্যাহত রাখেন।

ফার্স্ট লেডি হিসাবে মিসেস ক্লিনটন নারী অধিকার এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবার পক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠার মাধ্যমে দেশের ভেতরে ও বাইরে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।

উনিশশ’ নবব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে এবং বিল ক্লিন্টনের দ্বিতীয় মেয়াদের পুরো সময়টা জুড়ে মিঃ ক্লিন্টনের প্রেসিডেন্ট কালের নানা কেলেংকারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন হিলারিও।

হোয়াইটওয়াটার নামে অসফল এক ভবন ব্যবসা প্রকল্প নিয়ে কংগ্রেসে যে শুনানি ও তদন্ত হয় সেই তদন্তের অংশ ছিলেন ক্লিন্টন দম্পতিও। যদিও এই তদন্তে দুজনেই খালাস পেয়ে যান।

হোয়াইট হাউসের ইনটার্ন মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে বিল ক্লিন্টনের প্রেমের ঘটনা ১৯৯৮ সালে জানাজানি হবার সময়ও হিলারি ক্লিনটন গণমাধ্যমে আলোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।

ক্লিনটনের প্রেসিডেন্টকালের মেয়াদের প্রায় শেষ দিকে, ২০০০ সালে হিলারি নিউ ইয়র্ক স্টেটের মেয়রের পদে দাঁড়িয়ে জয়ী হন। ২০০৬ সালে সেনেটার হিসাবে তিনি আবার নির্বাচিত হন খুব সহজেই।

রিপাব্লিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প

ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে এসেছেন বর্ণাঢ্য চরিত্রের বিশিষ্ট ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই লড়াইয়ে তিনি যে এতদূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন, প্রথমে অনেকেই তা ভাবেননি।

অভিবাসন নিয়ে তাঁর বিতর্কিত অবস্থান, তার প্রচারণার আক্রমণাত্মক ধরন এবং তার অতীত তারকাখ্যাতি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দৌড়ে তাকে কতটা সাহায্য করবে তা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় ছিল।

কিন্তু রিপাব্লিকান পার্টির প্রাইমারি পর্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্যান্য সব ঝানু রাজনীতিকদের পেছনে ফেলে এবং সব পূর্বাভাস মিথ্যা প্রমাণ করে ৭০ বছরের এই ব্যবসায়ীই শেষ পর্যন্ত দলের মনোনয়ন পেয়ে এই দৌড়ে টিকে থেকেছেন।

বারাক ওবামার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রচারণা পর্বের গোড়ার দিকে বারবার প্রশ্ন তুলে ট্রাম্প নানা মহলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

২০০৮ সালের পর থেকে তিনি একটি আন্দোলন শুরু করেন যার মূল বিষয় ছিল বারাক ওবামার জন্ম আমেরিকায় কি না এবং ফলে দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্মগত অধিকার তার আছে কি না।

পরে অবশ্য এই আন্দোলন থিতিয়ে পড়ে যখন প্রমাণিত হয় যে বারাক ওবামার জন্ম আমেরিকার হাওয়াইয়ে। মিঃ ট্রাম্পও বিষয়টা মেনে নিয়েছিলেন- কিন্তু স্বভাবসুলভভাবে কখনই তিনি এই আন্দোলনের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন নি।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানোর জন্য প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেন ১৯৮৭ সালে। এমনকী রিফর্ম পার্টির প্রার্থী হিসাবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেমেছিলেন ২০০০ সালে।

২০১৬-র নির্বাচনের জন্য মিঃ ট্রাম্প ২০১৫ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জানান প্রেসিডেন্ট পদের জন্য মনোনয়ন পাবার লড়াইয়ে নামছেন তিনি।

নিউ ইর্য়কের ধনী সম্পত্তি ব্যবসায়ী ফ্রেড ট্রাম্পের চতুর্থ সন্তান ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য কিশোর বয়সে পাঠিয়ে পড়তে দেওয়া হয়েছিল সামরিক অ্যাকাডেমিতে ।

তিনি পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোর্য়াটন স্কুলে লেখাপড়া করেন এবং বড় ভাই ফ্রেড পাইলট হবার সিদ্ধান্ত নিলে বাবা তাকেই ব্যবসায়ে তার উত্তরসূরী নির্বাচন করেন।

প্রথম দিকে বাবাকে বিপুল পরিমাণ আবাসিক সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে সহায়তা করলেও ক্রমে তিনি বাবার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন এবং ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’।

১৯৯৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর ব্রুকলিন আর কুইন্স এলাকার আবাসিক ভবন কেনাবেচার পারিবারিক ব্যবসাকে তিনি নিয়ে যান অন্য মাত্রায়। এবার তিনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশটির হর্তাকর্তা হওয়ার দৌড়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।



মন্তব্য চালু নেই