ভোলায় কোকো ট্রাজেডি’র ৬ বছর, আজো কান্না থামেনি স্বজনহারাদের

আজ ২৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোলার কোকো-৪ লঞ্চ দূর্ঘটনার ট্রাজেডির ছয় বছর পূর্তি। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর শুক্রবার এই দিনে রাত ১১টায় ঢাকা থেকে লালমোহনগামী এমভি কোকো-৪ লঞ্চ নাজিপুর ঘাটের কাছাকাছি এসে ডুবে যায়। এতে ভোলার লালমোহনে ৪৫জন, চলফ্যাশনে ৩১জন, তজুমদ্দিনে ১ ও দৌলতখানে ৩ জনসহ মোট ৮১ জন প্রান হারায়। বছর ঘুরে এ দিনটি এলেও আজও ভোলার মানুষ এ দিনটির কথা ভুলতে পারেনি। স্বজনহারা মানুষের কান্না এখনও থামেনি। ওই দিনটির কথা মনে করে আজও আতকে ওঠেন তারা।

কোকো ট্রাজেডির ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও আজও এ রুটে চালু হয়নি নিরাপদ লঞ্চ। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়েই প্রতিদিন চরম ঝুঁকির মধ্যে যাতায়াত করছে ছোট ছোট লঞ্চ। একই সাথে দোষীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

উল্লেখ্য, দুই হাজারও বেশি ঈদের ঘরমূখো যাত্রীদের নিয়ে ঢাকা থেকে লালমোহনের উদ্যেশে রওনা হয়। রাত ১১ টার দিকে নাজিরপুর ঘাটের কাছাকাছি এলে লঞ্চটি ডুবে যায়। ওই সময় অনেকেই সাতরিয়ে তীরে উঠতে পারলেও পুরুষ, নারী, শিশুসহ মারা যান ৮১জন। নিহতদের যাত্রীদের মধ্যে লালমোহন, চরফ্যাশন ও দৌলতখানের যাত্রী ছিল বেশী।

স্থানীয়রা জানান, দুর্ঘটনার ২৪ঘন্টার মধ্যে কিছু যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও এরপর উঠে আসে একের পর এক লাশ। আস্তে আস্তে যেন লাশের মিছিলে পরিনত হয় নাজিরপুর ঘাট।

৭০’র বন্যার পর ভোলার মানুষ এর আগে এত বড় দুর্ঘটনা দেখেনি। কোকো-৪ লঞ্চ দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন পিতা-মাতা, কেউ হারিয়েছে সন্তান, কেউবা ভাই-বোন আর পরিবারের উপর্জনক্ষম ব্যাক্তি। স্বজনদের কান্নায় লালমোহন আকাশ ভারী হয়ে ও ঠেছিল সেদিন।

বেঁচে যাওয়া যাত্রী আলম জানান, লঞ্চটি অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঢাকা সদরঘাট থেকে ছেড়ে আসার সময় বুড়িগঙ্গা নদী পাড় হলে লঞ্চটির তলা ফেটে যায়। তবুও ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চটি লালমোহনের উদ্দেশ্যে আসছিল। যাত্রীরা লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েও তীরে নামতে পারেননি। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল। লালমোহন লঞ্চ ঘাটের কাছাকাছি নাজিরপুর লঞ্চ ঘাটে এমভি কোকো ৪ আসা মাত্র যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নামতে গেলে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ভাড়া আদায় করতে পারবে না ভেবে লঞ্চটি আবারও মাঝ নদীতে নেওয়ার চেষ্ঠা করে। একে অতিরিক্ত যাত্রী তার উপর তলা ফেটে যাওয়ায় পানি প্রবেশ করছিল। এক পর্যায়ে লঞ্চটি ডান দিকে কাত হয়ে ডুবি যায়। আর এতেই ঘটে দুর্ঘটনা। কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হয় উদ্ধার অভিযানে উঠে আসে একের পর এক লাশ। স্বজনদের কান্নায় সেদিন লালমোহনের আকাশ ভারী হয়ে ওঠেছিল।

অপরদিকে একই এলাকার বাকলাই বাড়ির শামসুন নাহার স্বামী, সন্তান, দেবরসহ একই বাড়ির ১৬ জন নিয়ে কোকো লঞ্চে রওনা হয়েছিল বাড়িতে ঈদ করার জন্য। বাড়ির কাছের ঘাটে এসেই লঞ্চডুবিতে নিহত হয় তার মেয়ে সুরাইয়া (৭), ভাসুরের মেয়ে কবিতা (৩) ও দেবর সোহাগ (১৩)। সেই থেকেই শামসুন নাহার আদরের মেয়ের শোকে কাতর। শামসুন নাহারের মত এ লঞ্চ দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন পিতা-মাতা, কেউ হারিয়েছে সন্তান, কেউবা ভাই- বোন আর পরিবারের উপর্জনক্ষম ব্যক্তি।

ভয়াবহ স্মরণকালের এ লঞ্চ দূর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের খবর রাখেনি কেউ। স্বজনহারাদের পরিবারে এখনো চলছে নীরব কান্না। ছেলে-সন্তান হারা অনেক বাবা-মার স্বপ্ন রয়ে গেছে অপূর্ণ। পরিবারের একমাত্র উপর্জনকারীকে হারিয়ে আগের অবস্থায় এখনো ফিরে আসতে পারেনি অনেক পরিবার। কেউ কেউ ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামে। দূর্ঘটনার পর নিহতদের পরিবারকে সরকারিভাবে কিছু আর্থিক সাহায্য করা হলেও পূণর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এব্যাপারে ভোলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ মাহমুদুর রহমান বলেন, এ দুর্ঘটনা নিহতের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগীতা করা হয়। ভবিষ্যতে যাতে আর কোন নৌ দুর্ঘটনা না ঘটতে পারে বিশেষ করে ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী ও ফিটনেস বিহীন লঞ্চ যাতে না চলতে পারে সে ব্যাপারে তাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে বলে তিনি জানান।

এদিকে স্বজনহারা পরিবার গুলোর দাবি, লঞ্চ মালিকদের খামখেয়ালির জন্য আর যেন কোনো মাকে সন্তান হারাতে না হয়। স্ত্রীকে যেন অকালে বিধবা হতে না হয়। কোকো ট্রাজেডির ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও আজও এ রুটে চালু হয়নি নিরাপদ লঞ্চ। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়েই প্রতিদিন চরম ঝুঁকির মধ্যে যাতায়াত করছে এই রুটের লঞ্চগুলো। একই সাথে দোষীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা।

আজ এ উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে লালমোহন ও চরফ্যাশনে দোয়া, মোনাজাত ও স্বরন সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করেছে।



মন্তব্য চালু নেই