মধ্যরাতে ছদ্মবেশে নগর ঘুরে বেড়ান জলিল মণ্ডল….!!!

গভীর রাত, শহরের রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। ঘুমে মগ্ন নগরবাসী। কিন্তু ছদ্মবেশে পথে পথে হাঁটছেন একজন। তার চোখে ঘুম নেই। কখনো প্রাইভেট কার, কখনো সিএনজি অটোরিকশা চেপে বেরিয়ে পড়েন তিনি। নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখতে ঘুরেন থানায়, ফাঁড়ি, অলিগলি ও বাস স্টেশন। এই অদ্ভুদ ব্যক্তি আর কেউ নয় তিনি চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল।

আকস্মিক হাজির হয়ে থানায় পর্যবেক্ষণ করেন নগরবাসীকে কেমন সেবা দিচ্ছে পুলিশ। সড়কের পাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেন, ট্রাফিক সার্জেন্ট কিংবা টহল পুলিশ যানবাহন থেকে চাঁদা নিচ্ছেন কি-না। দেখেন থানায় আসা লোকজনের সাথে কেমন আচরণ করছে পুলিশ।
মধ্যরাতে ছদ্মবেশ ধারণ করায় চাঞ্চল্য সৃষ্টির পাশপাশি থানা পুলিশ কর্মকর্তাদের আতংকও দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় দায়িত্ব পালনে নগর পুলিশ আগের চেয়ে অনেক সতর্ক বলে সিএমপি সূত্রে জানা গেছে।

১১ জানুয়ারি রাত দশটা। প্রাইভেট গাড়ি চেপে বাসা থেকে বের হন কমিশনার মণ্ডল। সঙ্গে নেন ২০-২২টি কম্বল। উদ্দেশ্য শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো। সেই রাতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল।

এসময় স্টেশন রোডে গিয়ে চোখ আটকে গেল তার। দেখলেন, শীতে জবুথবু হয়ে এক বৃদ্ধা বসে আছেন ফুটপাতে। শীতের তীব্রতায় কাঁপছে তার শরীর। কম্বল নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে সেটি পরিয়ে দিলেন বৃদ্ধার গায়ে।

ওইরাতে ফুটপাতে ঘুমন্ত ১৫-১৬ জন ভাসমান নারী-পুরুষকে কম্বল পরিয়ে দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে পুলিশ কমিশনার মণ্ডল বলেন, ‘তীব্র শীতের রাতে কম্বল পরিয়ে দেয়ার পর ভাসমান নারী-পুরুষ আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে থাকিয়ে থাকেন।’

ছদ্মবেশে থানায় ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে কমিশনার মণ্ডল বলেন, ‘আমি নিজেকে গোপন করার যতই চেষ্টা করি। বাইরের লোকজন আমাকে চিনে ফেলে। পোশাক না পরলেও অনেককে বলতে শুনেছি, ‘ওই যে যায় মণ্ডল।’

তিনি বলেন, ‘সরেজমিন দেখেছি-অনেকে সাধারণ ডায়েরি করতে থানায় ঘন্টার পর ঘন্টা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোনো পুলিশ সদস্য তাদের খোঁজ নিচ্ছেন না। অনেকে মনে করেন জিডি করতে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। তাই তারা পকেটে টাকা নিয়ে আসেন। আবার অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে জিডি করতে টাকা নেওয়ার অভিযোগও শোনা যায়। তবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কিছু পুলিশ সদস্যের মধ্যেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে।’

মণ্ডল জানান, ছদ্মবেশে কিছু থানায় দেখলাম-বাইরে অনেক মানুষের ভিড়। থানার বড় কর্তাকে তারা চিনেন না। থানার বাইরে কনস্টেবল দেখলে তাকেই বড় অফিসার বলে মনে করেন তারা। এ সময় অভিযোগ দিতে আসা অনেকের সমস্যার কথা শুনে তা তাৎক্ষণিক সমাধান করে দিয়েছি।’ দুঃস্থ‌্য মানুষের উপকার করে দোয়া পেতে চাই, বলেন তিনি।

২ জানুয়ারি রাত নয়টায় হঠাৎ হাজির হলেন আকবর শাহ থানায়। থানার বাইরে অনেক লোকের ভিড়। এ সময় তিনি দেখলেন এক যুবকের চেহারায় হতাশা ও দুশ্চিন্তার প্রভাব। কোমল গলায় যুবকের উদ্দেশ্যে কমিশনার মণ্ডল বললেন, ‘নিশ্চয় তোমার কোন বিপদ হয়েছে। আমাকে খুলে বল। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব।’

কমিশনার মণ্ডল ফের তাকে প্রশ্ন করেন, এত রাতে কেন থানায় এসেছ। উত্তরে যুবকটি বলেন, ‘৪ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি থানার বাইরে। বড় অফিসার কে তা জানি না। একটি জিডি করতে এসেছি। কার কাছে যাব?

এরপর যুবকটিকে সঙ্গে নিয়ে থানার ভেতরে গেলেন পুলিশ কমিশনার। ডিউটি অফিসার দিয়ে জিডি নথিভুক্ত করালেন। সমস্যার সমাধানের জন্য সশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন।

থানায় কর্তব্যরত অফিসারের মুখে ‘স্যার এক্ষুনি করে দিচ্ছি’ এ কথা শুনে যুবকটি হতবাক হয়ে গেলেন। পরে এক পুলিশ সদস্যের মাধ্যম যুবকটি জানতে পারলেন, তাকে সাহায্যকারী লোকটি সাধারণ কেউ নন, তিনি নগর পুলিশের প্রধান আবদুল জলিল মণ্ডল। এ কথা শুনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না ওই যুবক।

পাহাড়তলী থানায় গিয়ে হাজতিদের সাথে সম্প্রতি কথা বলেন মণ্ডল। এ সময় পুলিশ সদস্যরা কী রকম আচরণ করছেন তা জানতে চান হাজতির কাছে। তাদের অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।

সিএমপি’র কর্মকর্তা (ইমিগ্রেশন) তারেক আহমেদ বলেন, ‘পুলিশ কমিশনারের সরল জীবনের কথা অনেকেই জানেন না। নগরবাসীর কষ্টে বিচলিত হয়ে দিনের বেলায় তো বটেই। রাতের অন্ধকারে সাদা পোশাকে কখনো ছুটে যাচ্ছেন থানায়, কখনো ফুটপাতে কিংবা কখনো বাস স্টেশনে।’

জানা গেছে, ২৬ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এ যাবত এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অনেকবার।

২ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টা। প্রাইভেট গাড়িটি নিয়ে বের হলেন রাজপথে। দেওয়ানহাট ব্রিজের উপর গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন মন্ডল। দেখলেন পলিথিন টাঙিয়ে কিছু যুবক মাদক সেবন করছেন। মুহূর্তে তাদের পাকড়াও করে সোপর্দ করলেন সংশ্লিষ্ট থানায়।

১২ জানুয়ারি রাত দশটায় জিইসি মোড় এলাকায় গিয়ে কথা বললেন বিভিন্ন যানবাহন চালক-শ্রমিকদের সাথে। পুলিশ সার্জেন্টের বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ শুনলেন। সাথে সাথে ব্যবস্থাও নিলেন তিনি।

১০ জানুয়ারি। তখন রাত সাড়ে ১১টা। ছদ্মবেশে গেলেন চকবাজার কাপাসগোলা সড়কে। এ সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করছিল টহল পুলিশের পাঁচ সদস্য। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞ্যেস করলেন, খাবার-দাবার কিংবা কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা? উত্তরে তারা বললেন, ‘না স্যার’।

সিএমপির এক কর্মকর্তা জানান, দিনের বেলায় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াতের তিন সদস্য নিয়ে কমিশনার বিভিন্ন প্রোগামে অংশ নেন। কিন’ ছদ্মবেশে রাতে যখন তিনি বের হন তখন এক চালক ছাড়া আর কেউ থাকে না তার সঙ্গে। শহরে ঘোরাফেরার কথাও জানান না কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে।



মন্তব্য চালু নেই